ঢাকা ০৪:৪৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ১৫ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
নওগাঁর মান্দায় মিষ্টি আলুর গাছ কাটাকে কেন্দ্র করে কুপিয়ে জখম নওগাঁয় শিক্ষার্থীদের দিয়ে এইচপিভি টিকাদান কার্যক্রম উদ্বোধন নওগাঁয় পাগলা শিয়ালের আক্রমন ও কামড়ে ৩ নারীসহ ৫ জন আহত কাজ না করে সরকারি টাকা লোপাট” এর সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনী ব্যবস্থা গ্রহনের দাবীতে পথ সভা মান্দায় মণ্ডপে মণ্ডপে নগদ অর্থ উপহার দিলেন বিএনপি’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ডা, ইকরামুল বারী টিপু নওগাঁ মান্দা একরুখী হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের অনিয়ম দেখার মত মনে হয় কেহ নাই ভারতে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে নিয়ে কটুক্তির প্রতিবাদে এনায়েতপুরে বিক্ষোভ মিছিল দি সিলেট ইসলামিক সোসাইটিরপঞ্চম শ্রেণি মেধাবৃত্তি প্রদান সম্পন্ন নর্থইস্ট নার্সিং কলেজের শিক্ষার্থীদেরআন্দোলন, কলেজ বন্ধ ঘোষণা জগন্নাথপুরে আফজল হত্যার ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারের দাবীতে মানববন্ধন

আবহাওয়া বিপর্যয় : ইসলাম ও  আধুনিক বিজ্ঞানীদের দর্শন

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
  • আপডেট সময় : ০৬:৩৯:৪১ অপরাহ্ন, রবিবার, ৪ জুন ২০২৩ ৩৪ বার পড়া হয়েছে
আজকের জার্নাল অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি
মহাগ্রন্থ আল-কুরআন মহান আল্লাহর কথা বা নির্দেশনা সমষ্টি। বিভিন্ন যুগের নবীগণ-এর কাছে প্রেরিত ইলাহী প্রত্যাদেশের এটি সর্বশেষ সংযোজন। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে অনবদ্য এক শাশ্বত সুনিবিড় সম্পর্ক স্থাপনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো আল-কুরআনুল মাজীদ।
মানুষের হেদায়াতের জন্য অবতীর্ণ এই গ্রন্থে বিজ্ঞান নির্দেশক অসংখ্য তথ্যসম্বলিত ৭৫০টি আয়াত রয়েছে। যুগে যুগে বিজ্ঞানের বহুমাত্রিক আবিষ্কার ও জ্ঞানের সামগ্রিক উন্নয়ন ও বিকাশ আল-কুরআনের কোনো বক্তব্যকে বাস্তবতা বিবর্জিত বা বিজ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক হিসেবে উপস্থাপন না করে বরং কুরআনিক নির্দেশনাকে সত্যায়ন করেছে। চলমান বিজ্ঞানের বিকশিত গগণচুম্বি উৎকর্ষ মানুষের জীবনযাপনকে মসৃণ ও আরামদায়ক করে চলেছে প্রতিনিয়ত; ভবিষ্যতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে আরো নতুন নতুন ধারণা ও জ্ঞানের জন্ম হবে।
আর এজন্যই হয়তো মহান আল্লাহ তাঁর হেদায়াতের এই গ্রন্থে বিজ্ঞানসংশ্লিষ্ট আয়াতসমূহের অবতারণা করেছেন। পরিবেশ মানুষের জীবনে তীব্রভাবে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। আর এই পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো, আবহাওয়া। জীবের জীবনধারণের জন্য আবহাওয়া একটি অত্যাবশ্যকীয় অনুসঙ্গ। কোনো নির্দিষ্ট স্থানের বায়ুর উষ্ণতা, বায়ুচাপ, বায়ুপ্রবাহ, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত প্রভৃতি উপাদানের দৈনন্দিন অবস্থাই আবহাওয়া। স্থানভেদে আবহাওয়া খুব সহজেই পরিবর্তিত হয়। কোনো স্থানের আবহাওয়া প্রতিদিন বা প্রতি ঘণ্টায় পরিবর্তিত হয়। আমরা যে আবহম-লে বসবাস করি, তার ভেতর প্রতিনিয়ত নানা রকম আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
এই প্রভাবে সৃষ্টি হয় আহ্নিক গতি, বার্ষিক গতি, মেঘ, বৃষ্টি, ঝড়, তুফান ও ভূমিকম্প ইত্যাদি। পৃথিবীর এই প্রতিনিয়ত পরিবর্তন মানুষের স্থায়িত্বহীনতাই প্রমাণ করে। আর এজন্যই আল্লাহ তাআলা আবহাওয়া পরিবর্তনে জ্ঞানবানদের জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে মর্মে ঘোষণা দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন‘আর বায়ুর পরিবর্তনে বুদ্ধিমানদের জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে’।
[জ্ঞানীগণ এসব তথ্যের মাধ্যমে অদৃশ্য অলৌকিক মহান প্রভুর ক্ষমতা সম্পর্কে অবহিত হওয়ার সুযোগ পায়। বিজ্ঞানের অন্যান্য বিষয়ের মতো আবহাওয়াসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ের সুস্পষ্ট বর্ণনা আল-কুরআনে উপস্থাপিত হয়েছে। বক্ষমাণ প্রবন্ধে আল-কুরআনে আবহাওয়া বিজ্ঞানসংক্রান্ত নিদর্শনাবলি উপস্থাপন করা হবে।
আল-কুরআনে আবহাওয়া বিজ্ঞান : মহান আল্লাহ তাঁর সর্বশেষ প্রত্যাদেশ মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে আবহাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন উপাদান বিভিন্ন সূরায় বিচ্ছিন্নরূপে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন।
নিম্নে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরা হলো-
মেঘমালা : আল্লাহ তাআলা বলেন,আর আমরা জলধারী মেঘমালা থেকে প্রচুর বৃষ্টিপাত করি’ (আন-নাবা, ৭৮/১৪)। মহাশূন্যে অবস্থিত বাষ্পীয়ভাবে তৈরি হওয়া মেঘমালা থেকে বৃষ্টি হয়। জলকণা যখন সাগর, খাল-বিল, নদ-নদী থেকে বাষ্পীয়ভাবে উপরে ওঠে, তখন সেটা চারপাশের বা স্তরের চেয়ে হালকা হয়ে যায়। ফলে জলীয়বাষ্প উৎপন্ন হয়েই উপরের দিকে উঠতে থাকে। আবার ঊর্ধ্বগামী বায়ুপ্রবাহ শীতল হয়ে আসে এবং ঘনীভবনের মাধ্যমে সেটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জলকণায় পরিণত হয়। নির্দিষ্ট উচ্চতায় ও তাপে মেঘমালা তৈরি হয় এবং বিশেষ সময়ে মেঘমালা থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হয়।
এই সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তুমি কি দেখো না যে, আল্লাহ মেঘমালাকে সঞ্চালিত করেন, অতঃপর তাকে পুঞ্জীভূত করেন, অতঃপর তাকে স্তরে স্তরে রাখেন; অতঃপর তুমি দেখো যে, তার মধ্য থেকে বারিধারা নির্গত হয়। তিনি আকাশস্থিত শিলাস্তূপ থেকে শিলাবর্ষণ করেন এবং তা দ্বারা যাকে ইচ্ছা আঘাত করেন এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা, তা অন্যদিকে ফিরিয়ে দেন। তার বিদ্যুৎঝলক দৃষ্টিশক্তি যেন বিলীন করে দিতে চায়’ (আন-নূর, ২৪/৪৩)।
আবহাওয়ার পূর্বাভাস : আল্লাহ তাআলা বলেন ‘আমি বৃষ্টিগর্ভ বায়ু পরিচালনা করি, অতঃপর আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করি, এরপর তোমাদেরকে তা পান করাই। বস্তুত তোমাদের কাছে এর ভা-ার নেই’ (আল-হিজর, ১৫/২২)।
উক্ত আয়াতে বায়ুপ্রবাহের কথা বলা হয়েছে। এর মাধ্যমে আকাশ থেকে পানি বর্ষণের কথা ঘোষিত হয়েছে। বায়ুর প্রভাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ঝড়, বৃষ্টি, সাইক্লোন প্রভৃতি শুরু হওয়ার আগে এমন একটি বায়ু প্রবাহিত হয়; যার মধ্য থেকে মেটোরোগ্রাফ অঙ্কন করা যায়। অর্থাৎ তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বার গতিবেগ, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ, বজ্রবৃষ্টি (THUNDER STORMS), জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতির সার্বিক মানচিত্র পাওয়া যায় এবং এ মানচিত্র আগে ভাগে দেওয়ার নাম আবহাওয়ার পূর্বাভাস।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,আর আল্লাহর নিদর্শনাবলির একটি এই যে, তিনি সুসংবাদবাহী (পূর্বাভাস) বায়ু প্রেরণ করেন, যাতে তিনি তার অনুগ্রহ তোমাদেরকে আস্বাদন করাতে পারেন’ (আর-রূম, ৩০/৪৬)। আল-কুরআনে এটাকে বলেছে সুসংবাদবাহী পূর্বাভাস। সূরা আল-আ‘রাফে বলা হয়েছে, ‘তিনিই সে সত্তা যিনি অনুগ্রহপূর্বক বৃষ্টির পূর্বে সুসংবাদবাহী বায়ু পাঠিয়ে দেন। এমনকি যখন বায়ুরাশি পানি পূর্ণ মেঘমালা বয়ে আনে। তখন আমরা সেই মেঘমালাকে কোনো শুষ্ক ভূখ-ের দিকে পরিচালিত করি। অতঃপর সেই মেঘমালা থেকে পানি বর্ষণ করি। অতঃপর পানি দ্বারা সর্বপ্রকার ফসল উৎপন্ন করে দেই’ (আল-আ‘রাফ, ৭/৫৭)।
আজকাল কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে আবহাওয়া পরিস্থিতি নিরূপণ করা হয়। ১৯৬০ সালে সর্বপ্রথম আমেরিকা আবহাওয়া নিরূপক কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে উৎক্ষেপণ করেছিল। এ কৃত্রিম উপগ্রহগুলো নিচের দিকে শক্তিশালী ক্যামেরাযুক্ত এবং প্রতি দুমিনিট অন্তর ছবি তুলতে থাকে। ছবিগুলোকে বেতার তরঙ্গে পরিণত করে আবহাওয়া চিত্র বেতারের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয়। ভূপৃষ্ঠে পর্যবেক্ষণ কক্ষে গ্রাহক যন্ত্রে ঐ বেতার তরঙ্গ আবার চিত্রে রূপান্তরিত করার ব্যবস্থা আছে। এ ব্যবস্থার নাম AUTOMATIC PICTURE TRANSMISSION UNIT (APT). বর্তমানে আরো আধুনিক উপগ্রহের মাধ্যমে আবহাওয়া পরিস্থিতি নিরূপণ করা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লোকজনকে প্রচ- ঝড় এবং সম্ভাব্য জলোচ্ছ্বাসের জন্য এর মাধ্যমে সতর্ক করা হয়।
বৃষ্টিগর্ভ বায়ু : বিংশ শতাব্দী শুরুর পূর্বপর্যন্ত বিজ্ঞানীরা বাতাসের যে ফাংশনটি সম্পর্কে অবহিত ছিল সেটা হলো বাতাস মেঘকে চালনা করে। যাই হোক সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা ‘বৃষ্টিগর্ভ বায়ুর’ ভূমিকার কথা জানতে পেরেছে। বৃষ্টিগর্ভ বায়ুর ফাংশন হলো, সাগর মহাসাগরের পৃষ্ঠদেশে পানির ফেনার জন্য অসংখ্য বুদবুদ সৃষ্টি হয়। এই বুদবুদ হাজার হাজার অতি ক্ষুদ্র কণায় বিক্ষিপ্ত হয়। যার ব্যাস এক মিলিমিটারের একশত ভাগের এক ভাগ। অতঃপর বাতাসে তা নিক্ষিপ্ত হয়।
এই কণাগুলো অ্যারোসল (AEROSOLS) নামে পরিচিত। এই অ্যারোসল ধুলার সাথে মিশ্রিত হয়ে বাতাস দ্বারা ভূপৃষ্ঠ থেকে বাহির হয়ে আবহম-লের (ATMOSPHERE) উপরের স্তরে চলে যায়। এই কণা বাতাসবাহিত হয়ে উচ্চতর উচ্চতায় চলে যায় এবং সেখানে বর্তমান জলীয়বাষ্পের (WATER VAPOR) সংস্পর্শে আসে। জলীয়বাষ্প এই কণার চারিদিকে ঘনীভূত হয়ে পানির কণায় (WATER DROPLETS) পরিণত হয়। তারপর এই পানির কণা প্রথমে একত্রে জোড়া লেগে মেঘের গঠন করে। তারপর বৃষ্টির আকারে ভূপৃষ্ঠে পতিত হয়। কুরআনের আয়াতে বৃষ্টিপাতের জন্য বৃষ্টিগর্ভ বায়ুর (FECUNDATING) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা এভাবে বর্ণিত হয়েছে-আমি বৃষ্টিগর্ভ বায়ু পরিচালনা করি অতঃপর আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করি, এরপর তোমাদেরকে তা পান করাই। বস্তুত তোমাদের কাছে এর ভা-ার নেই’ (আল-হিজর, ১৫/২২)।
প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় পরিমিত বৃষ্টিপাত: পৃথিবীর সমস্ত জীবের বাঁচা নির্ভর করে পানির এই পরিমিত (MEASURE AMOUNT) আবর্তনের উপর। আমরা যদি আমাদের সমস্ত সম্পদ এবং প্রযুক্তি একত্র করি, তবুও আমাদের পক্ষে পানির এই আবর্তন কৃত্রিমভাবে ঘটানো সম্ভব নয়। আল-কুরআন আমাদের একটি নির্দিষ্ট অনুপাতে বৃষ্টিপাত সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়, যা প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য অত্যন্ত জরুরী। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,  ‘আর যিনি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন পরিমিত। তঃপর তাদ্বারা আমি মৃত ভূ-ভাগকে পুনরুজ্জীবিত করেছি। তোমরা এমনিভাবে উত্থিত হবে’ (আল-যুখরুফ, ৪৩/১১)। এখানে আল-কুরআন ‘পরিমিত’ (MEASURE AMOUNT) বারিপাত সম্পর্কে যে তথ্য আমাদের দেয়, তা আজ অনেক পর্যবেক্ষণ এবং গণনার ফলে নির্ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। গণনার ফলে দেখা গেছে যে, প্রতি সেকেন্ডে আনুমাণিক ১৬ মিলিয়ন টন পানি বাষ্পাকারে ভূপৃষ্ঠ থেকে উপরে উঠে। এই হিসাব অনুসারে প্রতি বছর ৫১৩ ট্রিলিয়ন টন পানি বাষ্পাকারে ভূপৃষ্ঠ থেকে উপরে উঠে। শুধু তাই নয় গণনার ফলে আরো দেখা গেছে যে, ঠিক এই একই পরিমাণ পানি বৃষ্টির আকারে পুনরায় পৃথিবীপৃষ্ঠে ফেরত আসে প্রতি বছর।
বিদ্যুৎ চমক : পানিভরা মেঘের আরেকটি দৃশ্য পরিলক্ষিত হয়, তাহলো বিদ্যুৎ চমক (LIGHTNING)। উচ্চ শক্তির উজ্জ্বল বিদ্যুৎক্ষরণ যা কোনো চার্জযুক্ত মেঘ এবং ভূপৃষ্ঠের কোনো অবস্থান বিন্দুর মধ্যে দুটি চার্জযুক্ত মেঘের মধ্যে অথবা একই মেঘের বিপরীত চার্জযুক্ত স্তরের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। সাধারণত মেঘের উপরের অংশ পজিটিভ চার্জযুক্ত এবং নিচের অংশ নেগেটিভ চার্জযুক্ত হয়। এই পার্থক্য সৃষ্টি হয় একটি জটিল প্রক্রিয়ায়। যখন মেঘকণা ও বৃষ্টিবিন্দু বায়ুর তীব্রতায় তাড়িত হয়ে মেঘের বরফজমা তাপবলয়ে পৌঁছে যায় তখন বৃষ্টিকণা জমে গিয়ে বরফের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কুচিগুলোকে নিক্ষেপ করে দেয়। এসব বরফকুচি পজিটিভ চার্জ বয়ে নিয়ে যায় এবং রেখে যায় নেগেটিভ চার্জ। পজিটিভ চার্জযুক্ত কণাগুলো বাতাসের তীব্র ঊর্ধ্বটানে মেঘের শীর্ষদেশে গিয়ে পৌঁছে। নেগেটিভ চার্জ নিয়ে ভারী কণাগুলো মেঘের নিম্নদেশে অবস্থান করে এবং মেঘের মধ্যে চার্জ পৃথকীকরণের কাজ সম্পন্ন করে। যখন বৈদ্যুতিক চার্জের গঠন খুব বেশি বড় হয়ে পড়ে তখন মধ্যবর্তী বাতাস তাদের পৃথক করে রাখতে পারে না। তাই একটা বিরাট স্ফুলিঙ্গ ঢেউ পজিটিভ অবস্থান থেকে নেগেটিভ অবস্থানের দিকে ধাবিত হয়। আর এটিই হলো বিদ্যুৎ চমক।
বজ্রপাত : আধুনিক আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা পানিভরা মেঘের মাঝে বজ্রের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বলেন, বৃষ্টিপাত শুরুর আগে অথবা বৃষ্টিপাত হওয়ার সময় পানিভরা মেঘে বিদ্যুৎ চ্যানেলে তড়িৎচার্জের বিরাট স্ফীতি অত্যধিক তাপ সৃষ্টি করে বাতাসের মধ্যে হঠাৎ ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটায় এবং বজ্রধ্বনি সৃষ্টি করে। বজ্রপাতের সময় তাৎক্ষণিকভাবে প্রায় ৩০,০০০ ডি. সেলসিয়াসের মতো উচ্চ তাপমাত্রা সৃষ্টি হয়। ফলে বজ্রপাতে উদ্ভিদ ও জীব বিদ্যুৎতাড়িত হয়ে মারা যায়। বজ্রপাত সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তিনিই তোমাদেরকে দেখান বিজলী যা ভয় ও ভরসা সঞ্চার করে এবং তিনিই সৃষ্টি করেন ঘন মেঘ’ (আর-রা‘দ, ১৩/১২)।
জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড় : বিজ্ঞানীরা বলেছেন, আবহাওয়ার নানা উপাদানের মধ্যে বাতাস সম্ভবত সবচেয়ে হেয়ালিময়। মূলত বাতাস হলো বায়ু যা গতিতে বিদ্যমান রয়েছে। তবে এমনকি একটি মাত্র মৌসুমেও বাতাসের শক্তি ও প্রবাহের দিকের মধ্যে যে বিরাট বৈচিত্র রয়েছে সেসবের কারণ বহু ও জটিল। স্থলভাগ থেকে বাতাসের প্রবাহ যখন সমুদ্রে এসে পড়ে বা সমুদ্র থেকে বাতাস স্থলভাগে প্রবাহিত হয়, তখন বাতাস যে শক্তি বা প্রচ-তায় প্রবাহিত হয়, তা সর্বদাই ক্রমাগতভাবে পরিবর্তনশীল। তাপমাত্রার বিন্যাস, পাহাড়-পর্বত ও অন্যান্য ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যগত কারণ ও সেই সাথে পৃথিবীর আপন কক্ষে আবর্তনের কারণে প্রবাহিত হয়। বাতাসের গতি বর্তমানে বিউফোর্ট (BEAUFORT) স্কেল দ্বারা নির্ণীত হয়ে থাকে। বাতাসের গতির ভিত্তিতে এই বিউফোর্ট স্কেলে জল বা স্থলভাগের পরিস্থিতি নির্ণয় করা যায়। আবহাওয়া বিজ্ঞানের পরিভাষায়, যখন বাতাস প্রবল বেগে বইতে থাকে ও বায়ুম-লের কোনো অঞ্চলে আলোড়নের সৃষ্টি করে তখন তাকে ঝড় বলে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে এই ধরনের ঝড় লক্ষ করা যায়। এমনকি বিভিন্ন সময়ে স্মরণকালের ঝড় কেড়ে নিয়েছে লাখো বনি আদমের প্রাণ। আল্লাহ তাআলা বলেন,তোমরা কি এ বিষয়ে নিশ্চিন্ত রয়েছ যে, তিনি তোমাদেরকে স্থলভাগে কোথাও ভূগর্ভস্থ করবেন না। অথবা তোমাদের উপর প্রস্তর বর্ষণকারী ঘূর্ণিঝড় প্রেরণ করবেন না, তখন তোমরা নিজেদের জন্য কোনো কর্মবিধায়ক পাবে না’ (আল-ইসরা, ১৭/৬৮)।
উক্ত আয়াতে মানুষকে হুঁশিয়ার করে দেওয়া হয়েছে যে, তারা যেন ধরাপৃষ্ঠে থাকতে পারছে বলেই নিজেদেরকে নিরাপদবোধ না করে। উল্লেখ করা হয়েছে স্থলভাগও ভূমিকম্প ও ঝড়ের ধাক্কা সাপেক্ষ। এই দুই প্রাকৃতিক দুর্বিপাক বিপর্যয় ঘটাতে পারে এবং তাতে বহুসংখ্যক লোকের প্রাণহানি ঘটতে পারে।
ভূকম্প ও আগ্নেয়গিরি : পৃথিবী প্রাকৃতিকভাবে তার অন্তর উন্মোচিত, প্রকাশিত রাখে গিরিখাত, ক্যানিয়ন, ভূ-ফাটল ইত্যাদির মাধ্যমে নানাভাবে। সূরা আর-রা‘দের ৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে, পৃথিবীর সকল ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে টেকটোনিক প্লেইটের সক্রিয়তার কারণে। টেকটোনিক স্তরগুলোর মধ্যে সংঘাত দেখা দিলে স্তরগুলো ধীরে ধীরে সরতে শুরু করে। এ ধরনের সঞ্চরণশীলতার গতি ৫ থেকে ১০ সেন্টিমিটার হারে বছরে হয়ে থাকে। বিশেষত অশ্মম-লীর স্তরের নিচে উষ্ণতার অবতলীয় গতি ও অভিকর্ষের কারণে এই সঞ্চরণ ঘটে। এসব শক্তির সংঘাতজনিত ব্যাপক ধীরগতির সঞ্চরণের ফলে ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরি ও পাহাড়-পর্বত সৃষ্টি হয়। যদি কোনো সামুদ্রিক ভারী শিলাস্তর বা প্লেইট কোনো অধিকতর প্লাবনশীল মহাদেশীয় শিলাস্তরের সাথে ধাক্কা খায়, তবে শেষোক্ত শিলাস্তর ভেতরের দিকে সরে যায়। আর এভাবে ভেতরে সরে আসার পর শিলাস্তরটি নিচের দিকে নেমে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ও পরিশেষে গলে যায়। আর এভাবে অপেক্ষাকৃত কম ঘন গলিত শিলা ভূপৃষ্ঠ অভিমুখে ওপরে উঠতে থাকে এবং একপর্যায়ে ভূপৃষ্ঠের কোনো বিদীর্ণ স্থান বা ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসে। যে স্থানটি আমাদের কাছে আগ্নেয়গিরি হিসেবে পরিচিত।
 উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মহান আল্লাহ মানবজাতির বসবাসের উপযোগী করে এই পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। যাতে মানুষ সুন্দর জীবনধারণের মাধ্যমে একমাত্র তারই উপাসনা বা ইবাদত করতে পারে। মানুষকে এই পৃথিবীতে বসবাসের ক্ষেত্রে তাকে পরিবেশ, আবহাওয়া ইত্যাদির সঙ্গে পরিচিত হতে হয়। আবহাওয়া আর পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে তার জীবন চলা। এ ক্ষেত্রে খরা, বৃষ্টি, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প ইত্যাদি প্রাকৃতিক ঘটনার সাথে মুখোমুখি হতে হয়। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে বিজ্ঞানের আবিষ্কারের বহু পূর্বেই এই সকল বিষয়ের বিবরণ বর্ণিত হয়েছে। এর মাধ্যমে দয়াময় প্রভু তাঁর ক্ষমতার প্রকাশ ঘটিয়ে মানুষকে শুধু তাঁরই ইবাদত করার নির্দেশনা দিয়েছেন।
লেখক- গবেষক, কলামিস্ট, মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান, পাঠান পাড়া, (খান বাড়ী) কদমতলী, সদর, সিলেট-৩১১১, মোবাঃ ০১৯৬৩৬৭১৯১৭

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

ট্যাগস :

আবহাওয়া বিপর্যয় : ইসলাম ও  আধুনিক বিজ্ঞানীদের দর্শন

আপডেট সময় : ০৬:৩৯:৪১ অপরাহ্ন, রবিবার, ৪ জুন ২০২৩
মহাগ্রন্থ আল-কুরআন মহান আল্লাহর কথা বা নির্দেশনা সমষ্টি। বিভিন্ন যুগের নবীগণ-এর কাছে প্রেরিত ইলাহী প্রত্যাদেশের এটি সর্বশেষ সংযোজন। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে অনবদ্য এক শাশ্বত সুনিবিড় সম্পর্ক স্থাপনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো আল-কুরআনুল মাজীদ।
মানুষের হেদায়াতের জন্য অবতীর্ণ এই গ্রন্থে বিজ্ঞান নির্দেশক অসংখ্য তথ্যসম্বলিত ৭৫০টি আয়াত রয়েছে। যুগে যুগে বিজ্ঞানের বহুমাত্রিক আবিষ্কার ও জ্ঞানের সামগ্রিক উন্নয়ন ও বিকাশ আল-কুরআনের কোনো বক্তব্যকে বাস্তবতা বিবর্জিত বা বিজ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক হিসেবে উপস্থাপন না করে বরং কুরআনিক নির্দেশনাকে সত্যায়ন করেছে। চলমান বিজ্ঞানের বিকশিত গগণচুম্বি উৎকর্ষ মানুষের জীবনযাপনকে মসৃণ ও আরামদায়ক করে চলেছে প্রতিনিয়ত; ভবিষ্যতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে আরো নতুন নতুন ধারণা ও জ্ঞানের জন্ম হবে।
আর এজন্যই হয়তো মহান আল্লাহ তাঁর হেদায়াতের এই গ্রন্থে বিজ্ঞানসংশ্লিষ্ট আয়াতসমূহের অবতারণা করেছেন। পরিবেশ মানুষের জীবনে তীব্রভাবে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। আর এই পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো, আবহাওয়া। জীবের জীবনধারণের জন্য আবহাওয়া একটি অত্যাবশ্যকীয় অনুসঙ্গ। কোনো নির্দিষ্ট স্থানের বায়ুর উষ্ণতা, বায়ুচাপ, বায়ুপ্রবাহ, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত প্রভৃতি উপাদানের দৈনন্দিন অবস্থাই আবহাওয়া। স্থানভেদে আবহাওয়া খুব সহজেই পরিবর্তিত হয়। কোনো স্থানের আবহাওয়া প্রতিদিন বা প্রতি ঘণ্টায় পরিবর্তিত হয়। আমরা যে আবহম-লে বসবাস করি, তার ভেতর প্রতিনিয়ত নানা রকম আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
এই প্রভাবে সৃষ্টি হয় আহ্নিক গতি, বার্ষিক গতি, মেঘ, বৃষ্টি, ঝড়, তুফান ও ভূমিকম্প ইত্যাদি। পৃথিবীর এই প্রতিনিয়ত পরিবর্তন মানুষের স্থায়িত্বহীনতাই প্রমাণ করে। আর এজন্যই আল্লাহ তাআলা আবহাওয়া পরিবর্তনে জ্ঞানবানদের জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে মর্মে ঘোষণা দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন‘আর বায়ুর পরিবর্তনে বুদ্ধিমানদের জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে’।
[জ্ঞানীগণ এসব তথ্যের মাধ্যমে অদৃশ্য অলৌকিক মহান প্রভুর ক্ষমতা সম্পর্কে অবহিত হওয়ার সুযোগ পায়। বিজ্ঞানের অন্যান্য বিষয়ের মতো আবহাওয়াসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ের সুস্পষ্ট বর্ণনা আল-কুরআনে উপস্থাপিত হয়েছে। বক্ষমাণ প্রবন্ধে আল-কুরআনে আবহাওয়া বিজ্ঞানসংক্রান্ত নিদর্শনাবলি উপস্থাপন করা হবে।
আল-কুরআনে আবহাওয়া বিজ্ঞান : মহান আল্লাহ তাঁর সর্বশেষ প্রত্যাদেশ মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে আবহাওয়ার গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন উপাদান বিভিন্ন সূরায় বিচ্ছিন্নরূপে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন।
নিম্নে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরা হলো-
মেঘমালা : আল্লাহ তাআলা বলেন,আর আমরা জলধারী মেঘমালা থেকে প্রচুর বৃষ্টিপাত করি’ (আন-নাবা, ৭৮/১৪)। মহাশূন্যে অবস্থিত বাষ্পীয়ভাবে তৈরি হওয়া মেঘমালা থেকে বৃষ্টি হয়। জলকণা যখন সাগর, খাল-বিল, নদ-নদী থেকে বাষ্পীয়ভাবে উপরে ওঠে, তখন সেটা চারপাশের বা স্তরের চেয়ে হালকা হয়ে যায়। ফলে জলীয়বাষ্প উৎপন্ন হয়েই উপরের দিকে উঠতে থাকে। আবার ঊর্ধ্বগামী বায়ুপ্রবাহ শীতল হয়ে আসে এবং ঘনীভবনের মাধ্যমে সেটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জলকণায় পরিণত হয়। নির্দিষ্ট উচ্চতায় ও তাপে মেঘমালা তৈরি হয় এবং বিশেষ সময়ে মেঘমালা থেকে বৃষ্টি বর্ষিত হয়।
এই সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তুমি কি দেখো না যে, আল্লাহ মেঘমালাকে সঞ্চালিত করেন, অতঃপর তাকে পুঞ্জীভূত করেন, অতঃপর তাকে স্তরে স্তরে রাখেন; অতঃপর তুমি দেখো যে, তার মধ্য থেকে বারিধারা নির্গত হয়। তিনি আকাশস্থিত শিলাস্তূপ থেকে শিলাবর্ষণ করেন এবং তা দ্বারা যাকে ইচ্ছা আঘাত করেন এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা, তা অন্যদিকে ফিরিয়ে দেন। তার বিদ্যুৎঝলক দৃষ্টিশক্তি যেন বিলীন করে দিতে চায়’ (আন-নূর, ২৪/৪৩)।
আবহাওয়ার পূর্বাভাস : আল্লাহ তাআলা বলেন ‘আমি বৃষ্টিগর্ভ বায়ু পরিচালনা করি, অতঃপর আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করি, এরপর তোমাদেরকে তা পান করাই। বস্তুত তোমাদের কাছে এর ভা-ার নেই’ (আল-হিজর, ১৫/২২)।
উক্ত আয়াতে বায়ুপ্রবাহের কথা বলা হয়েছে। এর মাধ্যমে আকাশ থেকে পানি বর্ষণের কথা ঘোষিত হয়েছে। বায়ুর প্রভাব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ঝড়, বৃষ্টি, সাইক্লোন প্রভৃতি শুরু হওয়ার আগে এমন একটি বায়ু প্রবাহিত হয়; যার মধ্য থেকে মেটোরোগ্রাফ অঙ্কন করা যায়। অর্থাৎ তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বার গতিবেগ, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ, বজ্রবৃষ্টি (THUNDER STORMS), জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতির সার্বিক মানচিত্র পাওয়া যায় এবং এ মানচিত্র আগে ভাগে দেওয়ার নাম আবহাওয়ার পূর্বাভাস।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,আর আল্লাহর নিদর্শনাবলির একটি এই যে, তিনি সুসংবাদবাহী (পূর্বাভাস) বায়ু প্রেরণ করেন, যাতে তিনি তার অনুগ্রহ তোমাদেরকে আস্বাদন করাতে পারেন’ (আর-রূম, ৩০/৪৬)। আল-কুরআনে এটাকে বলেছে সুসংবাদবাহী পূর্বাভাস। সূরা আল-আ‘রাফে বলা হয়েছে, ‘তিনিই সে সত্তা যিনি অনুগ্রহপূর্বক বৃষ্টির পূর্বে সুসংবাদবাহী বায়ু পাঠিয়ে দেন। এমনকি যখন বায়ুরাশি পানি পূর্ণ মেঘমালা বয়ে আনে। তখন আমরা সেই মেঘমালাকে কোনো শুষ্ক ভূখ-ের দিকে পরিচালিত করি। অতঃপর সেই মেঘমালা থেকে পানি বর্ষণ করি। অতঃপর পানি দ্বারা সর্বপ্রকার ফসল উৎপন্ন করে দেই’ (আল-আ‘রাফ, ৭/৫৭)।
আজকাল কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে আবহাওয়া পরিস্থিতি নিরূপণ করা হয়। ১৯৬০ সালে সর্বপ্রথম আমেরিকা আবহাওয়া নিরূপক কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে উৎক্ষেপণ করেছিল। এ কৃত্রিম উপগ্রহগুলো নিচের দিকে শক্তিশালী ক্যামেরাযুক্ত এবং প্রতি দুমিনিট অন্তর ছবি তুলতে থাকে। ছবিগুলোকে বেতার তরঙ্গে পরিণত করে আবহাওয়া চিত্র বেতারের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয়। ভূপৃষ্ঠে পর্যবেক্ষণ কক্ষে গ্রাহক যন্ত্রে ঐ বেতার তরঙ্গ আবার চিত্রে রূপান্তরিত করার ব্যবস্থা আছে। এ ব্যবস্থার নাম AUTOMATIC PICTURE TRANSMISSION UNIT (APT). বর্তমানে আরো আধুনিক উপগ্রহের মাধ্যমে আবহাওয়া পরিস্থিতি নিরূপণ করা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লোকজনকে প্রচ- ঝড় এবং সম্ভাব্য জলোচ্ছ্বাসের জন্য এর মাধ্যমে সতর্ক করা হয়।
বৃষ্টিগর্ভ বায়ু : বিংশ শতাব্দী শুরুর পূর্বপর্যন্ত বিজ্ঞানীরা বাতাসের যে ফাংশনটি সম্পর্কে অবহিত ছিল সেটা হলো বাতাস মেঘকে চালনা করে। যাই হোক সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা ‘বৃষ্টিগর্ভ বায়ুর’ ভূমিকার কথা জানতে পেরেছে। বৃষ্টিগর্ভ বায়ুর ফাংশন হলো, সাগর মহাসাগরের পৃষ্ঠদেশে পানির ফেনার জন্য অসংখ্য বুদবুদ সৃষ্টি হয়। এই বুদবুদ হাজার হাজার অতি ক্ষুদ্র কণায় বিক্ষিপ্ত হয়। যার ব্যাস এক মিলিমিটারের একশত ভাগের এক ভাগ। অতঃপর বাতাসে তা নিক্ষিপ্ত হয়।
এই কণাগুলো অ্যারোসল (AEROSOLS) নামে পরিচিত। এই অ্যারোসল ধুলার সাথে মিশ্রিত হয়ে বাতাস দ্বারা ভূপৃষ্ঠ থেকে বাহির হয়ে আবহম-লের (ATMOSPHERE) উপরের স্তরে চলে যায়। এই কণা বাতাসবাহিত হয়ে উচ্চতর উচ্চতায় চলে যায় এবং সেখানে বর্তমান জলীয়বাষ্পের (WATER VAPOR) সংস্পর্শে আসে। জলীয়বাষ্প এই কণার চারিদিকে ঘনীভূত হয়ে পানির কণায় (WATER DROPLETS) পরিণত হয়। তারপর এই পানির কণা প্রথমে একত্রে জোড়া লেগে মেঘের গঠন করে। তারপর বৃষ্টির আকারে ভূপৃষ্ঠে পতিত হয়। কুরআনের আয়াতে বৃষ্টিপাতের জন্য বৃষ্টিগর্ভ বায়ুর (FECUNDATING) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা এভাবে বর্ণিত হয়েছে-আমি বৃষ্টিগর্ভ বায়ু পরিচালনা করি অতঃপর আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করি, এরপর তোমাদেরকে তা পান করাই। বস্তুত তোমাদের কাছে এর ভা-ার নেই’ (আল-হিজর, ১৫/২২)।
প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় পরিমিত বৃষ্টিপাত: পৃথিবীর সমস্ত জীবের বাঁচা নির্ভর করে পানির এই পরিমিত (MEASURE AMOUNT) আবর্তনের উপর। আমরা যদি আমাদের সমস্ত সম্পদ এবং প্রযুক্তি একত্র করি, তবুও আমাদের পক্ষে পানির এই আবর্তন কৃত্রিমভাবে ঘটানো সম্ভব নয়। আল-কুরআন আমাদের একটি নির্দিষ্ট অনুপাতে বৃষ্টিপাত সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়, যা প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য অত্যন্ত জরুরী। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন,  ‘আর যিনি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন পরিমিত। তঃপর তাদ্বারা আমি মৃত ভূ-ভাগকে পুনরুজ্জীবিত করেছি। তোমরা এমনিভাবে উত্থিত হবে’ (আল-যুখরুফ, ৪৩/১১)। এখানে আল-কুরআন ‘পরিমিত’ (MEASURE AMOUNT) বারিপাত সম্পর্কে যে তথ্য আমাদের দেয়, তা আজ অনেক পর্যবেক্ষণ এবং গণনার ফলে নির্ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। গণনার ফলে দেখা গেছে যে, প্রতি সেকেন্ডে আনুমাণিক ১৬ মিলিয়ন টন পানি বাষ্পাকারে ভূপৃষ্ঠ থেকে উপরে উঠে। এই হিসাব অনুসারে প্রতি বছর ৫১৩ ট্রিলিয়ন টন পানি বাষ্পাকারে ভূপৃষ্ঠ থেকে উপরে উঠে। শুধু তাই নয় গণনার ফলে আরো দেখা গেছে যে, ঠিক এই একই পরিমাণ পানি বৃষ্টির আকারে পুনরায় পৃথিবীপৃষ্ঠে ফেরত আসে প্রতি বছর।
বিদ্যুৎ চমক : পানিভরা মেঘের আরেকটি দৃশ্য পরিলক্ষিত হয়, তাহলো বিদ্যুৎ চমক (LIGHTNING)। উচ্চ শক্তির উজ্জ্বল বিদ্যুৎক্ষরণ যা কোনো চার্জযুক্ত মেঘ এবং ভূপৃষ্ঠের কোনো অবস্থান বিন্দুর মধ্যে দুটি চার্জযুক্ত মেঘের মধ্যে অথবা একই মেঘের বিপরীত চার্জযুক্ত স্তরের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। সাধারণত মেঘের উপরের অংশ পজিটিভ চার্জযুক্ত এবং নিচের অংশ নেগেটিভ চার্জযুক্ত হয়। এই পার্থক্য সৃষ্টি হয় একটি জটিল প্রক্রিয়ায়। যখন মেঘকণা ও বৃষ্টিবিন্দু বায়ুর তীব্রতায় তাড়িত হয়ে মেঘের বরফজমা তাপবলয়ে পৌঁছে যায় তখন বৃষ্টিকণা জমে গিয়ে বরফের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কুচিগুলোকে নিক্ষেপ করে দেয়। এসব বরফকুচি পজিটিভ চার্জ বয়ে নিয়ে যায় এবং রেখে যায় নেগেটিভ চার্জ। পজিটিভ চার্জযুক্ত কণাগুলো বাতাসের তীব্র ঊর্ধ্বটানে মেঘের শীর্ষদেশে গিয়ে পৌঁছে। নেগেটিভ চার্জ নিয়ে ভারী কণাগুলো মেঘের নিম্নদেশে অবস্থান করে এবং মেঘের মধ্যে চার্জ পৃথকীকরণের কাজ সম্পন্ন করে। যখন বৈদ্যুতিক চার্জের গঠন খুব বেশি বড় হয়ে পড়ে তখন মধ্যবর্তী বাতাস তাদের পৃথক করে রাখতে পারে না। তাই একটা বিরাট স্ফুলিঙ্গ ঢেউ পজিটিভ অবস্থান থেকে নেগেটিভ অবস্থানের দিকে ধাবিত হয়। আর এটিই হলো বিদ্যুৎ চমক।
বজ্রপাত : আধুনিক আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা পানিভরা মেঘের মাঝে বজ্রের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বলেন, বৃষ্টিপাত শুরুর আগে অথবা বৃষ্টিপাত হওয়ার সময় পানিভরা মেঘে বিদ্যুৎ চ্যানেলে তড়িৎচার্জের বিরাট স্ফীতি অত্যধিক তাপ সৃষ্টি করে বাতাসের মধ্যে হঠাৎ ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটায় এবং বজ্রধ্বনি সৃষ্টি করে। বজ্রপাতের সময় তাৎক্ষণিকভাবে প্রায় ৩০,০০০ ডি. সেলসিয়াসের মতো উচ্চ তাপমাত্রা সৃষ্টি হয়। ফলে বজ্রপাতে উদ্ভিদ ও জীব বিদ্যুৎতাড়িত হয়ে মারা যায়। বজ্রপাত সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তিনিই তোমাদেরকে দেখান বিজলী যা ভয় ও ভরসা সঞ্চার করে এবং তিনিই সৃষ্টি করেন ঘন মেঘ’ (আর-রা‘দ, ১৩/১২)।
জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড় : বিজ্ঞানীরা বলেছেন, আবহাওয়ার নানা উপাদানের মধ্যে বাতাস সম্ভবত সবচেয়ে হেয়ালিময়। মূলত বাতাস হলো বায়ু যা গতিতে বিদ্যমান রয়েছে। তবে এমনকি একটি মাত্র মৌসুমেও বাতাসের শক্তি ও প্রবাহের দিকের মধ্যে যে বিরাট বৈচিত্র রয়েছে সেসবের কারণ বহু ও জটিল। স্থলভাগ থেকে বাতাসের প্রবাহ যখন সমুদ্রে এসে পড়ে বা সমুদ্র থেকে বাতাস স্থলভাগে প্রবাহিত হয়, তখন বাতাস যে শক্তি বা প্রচ-তায় প্রবাহিত হয়, তা সর্বদাই ক্রমাগতভাবে পরিবর্তনশীল। তাপমাত্রার বিন্যাস, পাহাড়-পর্বত ও অন্যান্য ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যগত কারণ ও সেই সাথে পৃথিবীর আপন কক্ষে আবর্তনের কারণে প্রবাহিত হয়। বাতাসের গতি বর্তমানে বিউফোর্ট (BEAUFORT) স্কেল দ্বারা নির্ণীত হয়ে থাকে। বাতাসের গতির ভিত্তিতে এই বিউফোর্ট স্কেলে জল বা স্থলভাগের পরিস্থিতি নির্ণয় করা যায়। আবহাওয়া বিজ্ঞানের পরিভাষায়, যখন বাতাস প্রবল বেগে বইতে থাকে ও বায়ুম-লের কোনো অঞ্চলে আলোড়নের সৃষ্টি করে তখন তাকে ঝড় বলে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে এই ধরনের ঝড় লক্ষ করা যায়। এমনকি বিভিন্ন সময়ে স্মরণকালের ঝড় কেড়ে নিয়েছে লাখো বনি আদমের প্রাণ। আল্লাহ তাআলা বলেন,তোমরা কি এ বিষয়ে নিশ্চিন্ত রয়েছ যে, তিনি তোমাদেরকে স্থলভাগে কোথাও ভূগর্ভস্থ করবেন না। অথবা তোমাদের উপর প্রস্তর বর্ষণকারী ঘূর্ণিঝড় প্রেরণ করবেন না, তখন তোমরা নিজেদের জন্য কোনো কর্মবিধায়ক পাবে না’ (আল-ইসরা, ১৭/৬৮)।
উক্ত আয়াতে মানুষকে হুঁশিয়ার করে দেওয়া হয়েছে যে, তারা যেন ধরাপৃষ্ঠে থাকতে পারছে বলেই নিজেদেরকে নিরাপদবোধ না করে। উল্লেখ করা হয়েছে স্থলভাগও ভূমিকম্প ও ঝড়ের ধাক্কা সাপেক্ষ। এই দুই প্রাকৃতিক দুর্বিপাক বিপর্যয় ঘটাতে পারে এবং তাতে বহুসংখ্যক লোকের প্রাণহানি ঘটতে পারে।
ভূকম্প ও আগ্নেয়গিরি : পৃথিবী প্রাকৃতিকভাবে তার অন্তর উন্মোচিত, প্রকাশিত রাখে গিরিখাত, ক্যানিয়ন, ভূ-ফাটল ইত্যাদির মাধ্যমে নানাভাবে। সূরা আর-রা‘দের ৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে, পৃথিবীর সকল ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে টেকটোনিক প্লেইটের সক্রিয়তার কারণে। টেকটোনিক স্তরগুলোর মধ্যে সংঘাত দেখা দিলে স্তরগুলো ধীরে ধীরে সরতে শুরু করে। এ ধরনের সঞ্চরণশীলতার গতি ৫ থেকে ১০ সেন্টিমিটার হারে বছরে হয়ে থাকে। বিশেষত অশ্মম-লীর স্তরের নিচে উষ্ণতার অবতলীয় গতি ও অভিকর্ষের কারণে এই সঞ্চরণ ঘটে। এসব শক্তির সংঘাতজনিত ব্যাপক ধীরগতির সঞ্চরণের ফলে ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরি ও পাহাড়-পর্বত সৃষ্টি হয়। যদি কোনো সামুদ্রিক ভারী শিলাস্তর বা প্লেইট কোনো অধিকতর প্লাবনশীল মহাদেশীয় শিলাস্তরের সাথে ধাক্কা খায়, তবে শেষোক্ত শিলাস্তর ভেতরের দিকে সরে যায়। আর এভাবে ভেতরে সরে আসার পর শিলাস্তরটি নিচের দিকে নেমে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ও পরিশেষে গলে যায়। আর এভাবে অপেক্ষাকৃত কম ঘন গলিত শিলা ভূপৃষ্ঠ অভিমুখে ওপরে উঠতে থাকে এবং একপর্যায়ে ভূপৃষ্ঠের কোনো বিদীর্ণ স্থান বা ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসে। যে স্থানটি আমাদের কাছে আগ্নেয়গিরি হিসেবে পরিচিত।
 উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, মহান আল্লাহ মানবজাতির বসবাসের উপযোগী করে এই পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। যাতে মানুষ সুন্দর জীবনধারণের মাধ্যমে একমাত্র তারই উপাসনা বা ইবাদত করতে পারে। মানুষকে এই পৃথিবীতে বসবাসের ক্ষেত্রে তাকে পরিবেশ, আবহাওয়া ইত্যাদির সঙ্গে পরিচিত হতে হয়। আবহাওয়া আর পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে তার জীবন চলা। এ ক্ষেত্রে খরা, বৃষ্টি, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প ইত্যাদি প্রাকৃতিক ঘটনার সাথে মুখোমুখি হতে হয়। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে বিজ্ঞানের আবিষ্কারের বহু পূর্বেই এই সকল বিষয়ের বিবরণ বর্ণিত হয়েছে। এর মাধ্যমে দয়াময় প্রভু তাঁর ক্ষমতার প্রকাশ ঘটিয়ে মানুষকে শুধু তাঁরই ইবাদত করার নির্দেশনা দিয়েছেন।
লেখক- গবেষক, কলামিস্ট, মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান, পাঠান পাড়া, (খান বাড়ী) কদমতলী, সদর, সিলেট-৩১১১, মোবাঃ ০১৯৬৩৬৭১৯১৭