ইতিকাফের গুরুত্ব, তাৎপর্য, ফাযাইল ও মাসাইল: মুফতি জিয়াউর রহমান
- আপডেট সময় : ০৬:২৮:২৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৭ এপ্রিল ২০২৩ ৬২ বার পড়া হয়েছে
ইতিকাফ এমন এক বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ও মাহাত্মপূর্ণ ইবাদত, যার মাধ্যমে বান্দা সরাসরি আল্লাহ তাআলার সান্নিধ্যে চলে যায়। বান্দা যখন দুনিয়ার সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে আল্লাহর ঘর মসজিদে এসে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করে নেয়, তখন আল্লাহর সাথে বান্দার একটা বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন হয়।
ইতিকাফ শব্দ উকূফ (عكوف) থেকে উদ্গত হয়েছে৷ এর অর্থ হলো, অবস্থান করা, আঁকড়ে ধরা, নিজেকে আবদ্ধ করে রাখা৷ (লিসানুল আরব: ৯/২৫৫) শরীয়তের পরিভাষায় ইতিকাফ বলা হয়, কোনো মুসলিম দুনিয়ার সম্পর্ক ছিন্ন করে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ইবাদতের উদ্দেশ্যে নিজেকে মসজিদে আবদ্ধ করে নেয়া।
আল-কুরআনে ইতিকাফের আলোচনা-ইতিকাফকারীর মর্যাদা আল্লাহ তাআলার কাছে অনেক। বড় বড় দুইজন নবীকে আল্লাহ তাআলা হুকুম করেছেন যে, তাঁরা যেন ইতিকাফকারীর জন্য মসজিদ পরিচ্ছন্ন করেন৷ মর্যাদা কী পরিমাণ, এখান থেকেই অনুমান করা যায়।
ইরশাদ হচ্ছে-অর্থ: এবং আমি ইবরাহীম ও ইসমাঈলকে হুকুম করি, তােমরা আমার ঘরকে সেই সকল লােকের জন্য পবিত্র কর, যারা (এখানে) তাওয়াফ করবে, ইতিকাফ করবে এবং রুকু ও সিজদা আদায় করবে। (সূরা বাকারা: ১২৫)
ইতিকাফ অবস্থায় স্ত্রীদের সাথে কি আচরণ হবে তা বলতে গিয়ে কুরআনে কারীমে ইরশাদ হচ্ছে- অর্থ: আর তাদের সাথে (স্ত্রীদের সাথে) সহবাস করাে না, যখন তােমরা মসজিদে ইতিকাফরত থাক। (সূরা বাকারা: ১৮৭)
শষ দশক ও ইতিকাফ
আম্মাজান আয়িশা সিদ্দীকা রাযি. নবীজীর শেষ দশকের আমলের বিবরণ দিয়ে বলেন-
অর্থ: রাসূলুল্লাহ ﷺ অন্য দিনগুলোর তুলনায় রমযানের শেষ দশকে বেশি ইবাদত করতেন।(সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১১৭৫)
হাদীসে ইতিকাফের বিবরণ
উম্মুল মুমিনীন আয়িশা রাযি. বলেন- অর্থ: রাসূল ﷺ মৃত্যু পর্যন্ত রামাযান মাসের শেষ দশ দিন ইতিকাফ করেছেন। অতঃপর তাঁর পরে তাঁর স্ত্রীগণ ইতিকাফ করেছেন। (সহীহ বুখারী হাদীস নং-২০২৬, মুসলিম হাদীস নং-১১৭২) নবী করীম ﷺ প্রতি বছর দশ দিন ইতিকাফ করতেন। এমনকি যে বছর তিনি মৃত্যুবরণ করেন, সে বছর তিনি বিশ দিন ইতিকাফ করেন। আবু হুরায়রা রাযি. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন- অর্থ: রাসূল ﷺ প্রতি রামাযান মাসে দশ দিন ইতিকাফ করতেন। যে বছর তিনি মৃত্যুবরণ করেন সে বছর বিশ দিন ইতিকাফ করেন। (সহীহ বুখারী হাদীস নং-২০৪৪)
অর্থ: ইবনু আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণিত। রসূলুল্লাহ ﷺ ইতিকাফকারী সম্পর্কে বলেন: সে নিজেকে গোনাহ থেকে বিরত রাখে এবং নেককারদের সকল নেকী (যা ইতিকাফে না থাকার সুবাদে অর্জন করছে) তার জন্য জারি থাকে। (ইবনু মাজাহ হাদিস নং-১৭৮১)
ইতিকাফের ফযীলত সম্পর্কে এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেন- অর্থ: আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির নিয়তে যে ব্যক্তি মাত্র একদিন ইতিকাফ করবে আল্লাহ তাআলা তার ও জাহান্নামের মাঝে তিনটি পরিখার সমান দূরত্ব সৃষ্টি করে দিবেন। প্রতিটি পরিখার দূরত্ব হবে আসমান-জমিনের মধবর্তী দূরত্বের সমান। (মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৮/৩৫১-৩৫২; শুআবুল ঈমান ৩/৪২৫, হাদিস নং-৩৯৬৫, সনদ উত্তম)
ইতিকাফ তিন প্রকার:
সুন্নাত ইতিকাফ: রামাযানের শেষ দশকেরে ইতিকাফ। অর্থাৎ ২০ রমজানের সূর্য ডোবার আগ মুহূর্ত থেকে শাওয়াল মাসের চাঁদ উঠা পর্যন্ত মসজিদে ইতিকাফ করা। এ ধরনের ইতিকাফকে সুন্নাতে মুয়াক্কাদায়ে কিফায়া বলা হয়। গ্রাম বা মহল্লাবাসীর পক্ষে কোনো এক বা একাধিক ব্যক্তি এই এতেকাফ করলে সবার পথ থেকে তা আদায় হয়ে যাবে।
হাদীসের আলোকে এর দালিলিক আলোচনা তো উপরে করা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ প্রায় সব রামাযানেই ইতিকাফ করতেন৷ উজর ছাড়া ইতিকাফ ছাড়তেন না। ওয়াজিব ইতিকাফ: অর্থাৎ নিজের উপর আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট দিনের ইতিকাফ আবশ্যক করা৷ যাকে নজর বা মান্নতের ইতিকাফ বলে। এটি ওয়াজিব৷ যেমন কেউ বলল যে, আমার অমুক কাজ সমাধা হলে আমি এত দিন ইতিকাফ করব অথবা কোনো কাজের শর্ত উল্লেখ না করেই বলল, আমি এত দিন অবশ্যই ইতিকাফ করব। যত দিন শর্ত করা হবে তত দিন ইতিকাফ করা ওয়াজিব। ওয়াজিব ইতিকাফের জন্য রোজা রাখা শর্ত। (আদ্দুররুল মুখতার: ২/৪৪১)
ইবনু উমর রাযি. সূত্রে বর্ণিত যে- অর্থ: উমর রাযি. নবী ﷺকে জিজ্ঞেস করেন যে, আমি জাহিলিয়াতের যুগে মসজিদুল হারামে এক রাত ইতিকাফ করার মান্নত করেছিলাম। তিনি (উত্তরে) বললেন: তোমার মান্নত পুরা কর। (বুখারী হাদীস নং-১৯০৪, মুসলিম হাদীস নং-১৬৫৬)
নফল ইতিকাফ: সাধারণভাবে যে কোনো সময় ইতিকাফ করা নফল। এর কোনো দিন কিংবা সময়ের পরিমাপ নেই। অল্প সময়ের জন্যেও ইতিকাফ করা যেতে পারে। এ জন্য মসজিদে প্রবেশের আগে ইতিকাফের নিয়ত করে প্রবেশ করা উচিত৷ (আদ্দুররুল মুখতার: ২/১৭৭, মারাকিল ফালাহ: ১১৮)
লাইলাতুল কদর
লাইলাতুল কদর এই উম্মতের জন্য আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে এমন এক উপহার, যা পূর্ববতী উম্মতকে দেয়া হয় নি। পূর্ববতী উম্মত অনেক দীর্ঘ জীবন লাভ করতেন৷ এই উম্মতের বয়স মাত্রল৬০-৭০ বছর৷ সেই কমতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্যই আল্লাহ তাআলা কদরের রাত দিয়েছেন। নিজেই তার ফযীলত বর্ণনা করেছেন। ইতিকাফের আসল যে উপকার তা হচ্ছে, লাইলাতুল কাদর পাওয়া৷ যতদিন পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ ﷺ কে অবগত করা হয় নাই যে, কদরের রাত শেষ দশকে, ততদিন পর্যন্ত প্রথম ও দ্বিতীয় দশকেও তিনি ইতিকাফ করেছেন৷ উদ্দেশ্য ছিলো লাইলাতুল কদর পাওয়া৷ কেননা কদরের রাত হচ্ছে, রাতসমূহের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ রাত। এই রাতের ফযীলতের আলোচনা আল্লাহ তাআলা নিজেই করেছেন।
কুরআনুল কারিমে ঘোষণা হয়েছে- অর্থ: লাইলাতুল কদর হলো হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ৷ (সুরা কদর : আয়াত-৩)।
আবু হুরাইরা রাযি. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল ﷺ ইরশাদ করেন-
অর্থ: যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় কদরের রাতে জাগ্রত থেকে ইবাদত করবে, তার পূর্বের সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। (সহীহ বুখারী হাদিস নং-৩৫; সহীহ মুসলিম হাদিস নং-১৭৬)
শবে কদরে কী দুআ করব?
লাইলাতুল কদর যেহেতু সর্বশ্রেষ্ঠ ও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ রজনী, তাই এ রাতে বিশেষ কিছুই চাওয়া দরকার। তো আমি বিশেষভাবে কী চাইব এবং কীভাবে চাইব? আল্লাহর রাসূল ﷺ আমাদেরকে তা-ও শিখিয়ে দিয়েছেন। আয়েশা রাযি. নবীজীকে জিজ্ঞেস করেন- ইয়া রাসূলাল্লাহ! যদি আমি জানতে পারি, আজ লাইলাতুল কদর তাহলে আমি কী দুআ করব? নবীজী ﷺ বললেন, তুমি বলো-
অর্থ: আয় আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল। আপনি ক্ষমা করতে ভালোবাসেন। সুতরাং আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। (তিরমিযী হাদীস নং-৩৫১৩) একজন মুমিনের জন্য তার রবের পক্ষ থেকে ক্ষমা ও সন্তুষ্টি অপেক্ষা বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে! তাৎপর্যপূর্ণ এ দুআটি কেবল লাইলাতুল কদরের জন্যই নির্ধারিত নয়। ব্যাপক অর্থবোধক এই দুআটি পুরো রামাযানেই; ইফতারের সময়, সাহরীর সময় এবং অন্যান্য সময়েও পড়া যায়। এমনকি রমযান ছাড়াও এ দুআ পড়া যায়।
শবে কদর তালাশে ইতিকাফ
রাসূলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেন- অর্থ: রাসূল ﷺ বলেন: আমি লাইলাতুল কদরের সৌভাগ্য ও মহিমা অনুসন্ধানে প্রথম দশদিন ও মাঝের দশদিন ইতিকাফ করেছি অবশেষে আমার কাছে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়েছে যে, লাইলাতুল কদর শেষ দশকে। কাজেই তোমাদের মধ্যে যারা ইতিকাফ করতে চায় তারা যেন শেষ দশকে ইতিকাফ করে। (সহীহ বুখারী হাদিস নং-২০১৮)
আয়িশা রাযি. হতে বর্ণিত তিনি বলেন-
অর্থ: আল্লাহর রাসূল ﷺ রমাযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন এবং বলতেন: তোমরা রমাযানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান কর। (বুখারী হাদীস নং-২০২০, মুসলিম হাদীস নং-১১৬৯)
আরেক বর্ণনায় এসেছে- অর্থ: তোমরা শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে কদর অন্বেষণ কর। (সহীহ বুখারী হাদীস নং-২০১৬)
আয়িশা রাযি. থেকে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর শেষ দশকের আমলের বিবরণ বর্ণিত হয়েছে- অর্থ: যখন রামাযানের শেষ দশক আসত, তখন নবী কারীম ﷺ তাঁর লুঙ্গি কষে নিতেন (বেশি বেশি ইবাদতের প্রস্তুতি নিতেন) এবং রাত জেগে থাকতেন ও পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন। (বুখারী হাদিস নং-২০২৪, মুসলিম হাদিস নং-১১৭৪) ইবনু শিহাব যুহরী রাহ. বলেছেন, আশ্চর্য লাগে, কিভাবে লোকেরা ইতেকাফ ছাড়ে! রাসূলুল্লাহ ﷺ অনেক আমল করেছেন, আবার কখনো সে আমল ছেড়েও দিয়েছেন। কিন্তু তিনি ওফাত পর্যন্ত কখনো এতেকাফ ছাড়েন নি। (ইমাম সারাখসী, আল মাবসূত: ৩/১১৪)
ইতিকাফকারীর জন্য কতিপয় বিধান
যিনি ইতিকাফ করবেন ২০ রামাযান সূর্যাস্তের আগে আগেই ইতিকাফের উদ্দেশ্যে মসজিদে প্রবেশ করে নিতে হবে। ইতিকাফকারী একান্ত প্রয়োজন ব্যতীত মসজিদ থেকে বের হতে পারবে না। একান্ত প্রয়োজন মানে হচ্ছে, খাবার মসজিদে পৌঁছানোর লোক না থাকলে নিজে ঘর থেকে খাবার আনতে পারবে৷ ইস্তেনজার জন্য বের হতে পারবে। শরয়ী উজর না থাকলে স্বাভাবিক অবস্থায় অন্য আর কোনো প্রয়োজনে বের হতে পারবেন না।
অর্থ: আয়িশা রাযি. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, ইতিকাফের নিয়ম হচ্ছে যে ইতিকাফ করবে, সে (মসজিদ থেকে বের হয়ে) কোনো রোগীর পরিচর্যার জন্য গমন করবে না, জানাযার নামাযে শরীক হবে না, স্ত্রীকে স্পর্শ করবে না এবং তার সাথে সহবাস করবে না। আর সে যেন বিশেষ প্রয়োজন ব্যতীত মসজিদ হতে বের না হয়। রোযা ব্যতীত ইতিকাফ নেই৷ (আবু দাউদ হাদীস নং-২৪৭৩, সনদ সহীহ)
আয়িশা রাযি. আরো বলেন-
অর্থ: রাসূলুল্লাহ ﷺ ইতিকাফ অবস্থায় রোগীর পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় চলতে চলতে তাদের অবস্থা জিজ্ঞেস করে নিতেন৷ দাঁড়াতেন না৷ (আবু দাউদ হাদীস নং-২৪৬৪) এই বর্ণনা থেকে বোঝা গেলো ইতিকাফকারী যদি শরয়ী কোনো প্রয়োজনে বের হন, তাহলে কোথাও এক মুহূর্তও দাঁড়ানো যাবে না। তবে হেঁটে হেঁটে কারো সঙ্গে সংক্ষিপ্ত কুশল বিনিময় বা রোগীর অবস্থা জিজ্ঞেস করা যাবে। কিন্তু এই উদ্দেশ্য থামা জায়েয নয়৷ (আহকামে ইতিকাফ: ২২)
ইতিকাফ কারা করবে?
-মুসলমান, জ্ঞানসম্পন্ন লোক ইতিকাফ করবে৷ কোনো কাফিরের ইতিকাফ গ্রহণযোগ্য নয়৷ ছোট বাচ্চারা নামায যেমন পড়তে পারে, ইতিকাফও করতে পারবে৷ (বাদায়িউস সানায়ি: ২/১০৮) এমন ছোট বাচ্চার ইতিকাফের অনুমতি নেই, যে মসজিদের মর্যাদা বোঝে না৷ ইতিকাফের মর্ম জানে না৷ তাই বুঝসম্পন্ন নাবালেগ বাচ্চার ইতিকাফ সহীহ হবে৷
-নারীরাও ইতিকাফ করতে পারবেন। তবে স্বামীর অনুমতি লাগবে৷ তারা নিজ ঘরে নির্দিষ্ট একটি জায়গা ইবাদতের জন্য নির্ধারণ করে সেখানে বসে বসে ইতিকাফ করবেন। তারা কোনো ভাবেই মসজিদে ইতিকাফ করতে পারবেন না। ঠিক তদ্রূপ নারীরা হায়েযের সময়সীমা হিসাব করে ইতিকাফে বসবেন৷ যাতে ইতিকাফের মধ্যখানে হায়েয শুরু হয়ে ইতিকাফ বিনষ্ট না হয়৷ কেননা ইতিকাফের জন্য সব রকমের অপবিত্রতা থেকে পবিত্র থাকা শর্ত। অর্থ: অপবিত্রতা, হায়েয এবং নেফাস থেকে পাক থাকা উভয় প্রকার ইতিকাফ তথা ওয়াজিব ও নফল ইতিকাফ বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্ত৷ (বাদায়েউস সানায়ে: ২/২৭৪)
কিফায়া ইতিকাফ
রামাযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করা সুন্নাতে মুআক্কাদা আলাল কিফায়া৷ এক মহল্লা থেকে কিছু মানুষ মসজিদে ইতিকাফ করে নিলে সবার পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে৷ মহল্লা থেকে কেউ ইতিকাফ না করলে সবাই সুন্নাতে মুআক্কাদা ছাড়ার গোনাহগার হবে৷
অর্থ: রামাযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করা সুন্নাতে মুআক্কাদা কিফায়া৷ (রদ্দুল মুহতার: ২/৪৪২)
ইতিকাফের কতিপয় মাসাইল
-ইতিকাফের বড় রোকন হচ্ছে, ইতিকাফকারী ইতিকাফকালীন সময় পুরোটা মসজিদের এরিয়ার ভিতর থাকা। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া এক মুহূর্তের জন্যও মসজিদ থেকে বের হওয়া যাবে না৷ শরয়ী প্রয়োজন ছাড়া এক মুহূর্তের জন্যও মসজিদ থেকে বের হলে ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে। (আহকামে ইতিকাফ: ৩২) -মৌলিকভাবে পুরুষের ইতিকাফের জন্য মসজিদ শর্ত৷ মসজিদ ছাড়া ইতিকাফ সহীহ হবে না। জামে মসজিদ না হলেও চলবে৷ তবে অন্তত মসজিদ পাঞ্জেগানা হতে হবে৷ যেখানে পাঁচ ওয়াক্তের নামায আদায় করা হয়৷ (মারাকিল ফালাহ: ৫৭৭)
-মসজিদের এরিয়া হচ্ছে, ওয়াকফকারী যে অংশকে মূল মসজিদ হিসেবে ওয়াকফ করেছেন৷ ওযুখানা, বাথরুম, ইমাম-মুআযযিন সাহেবানদের হুজরা, গুদামঘর, জানাযার নামাযের পৃথক জায়গা, উপরতলায় উঠার সিঁড়ি এসব মূল মসজিদের অন্তর্ভুক্ত নয়৷ এসব স্থানে বের হওয়া ইতিকাফকারীর জন্য জায়েয নয়৷ (আহকামে ইতিকাফ: ৩৩) -ইতিকাফকারী জানাযার নামাযের জন্য মসজিদ থেকে বের হলেও ইতিকাফ ফাসিদ হয়ে যাবে৷ (রদ্দুল মুহতার: ২/৪৪৮)
-ইতিকাফকারী যদি ভুলক্রমে মসজিদ থেকে মুহূর্তের জন্যও বের হয়ে যায়, তাহলে ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে৷ (আদ্দুররুল মুখতার: ৩/৪৩৭) -ইতিকাফ অবস্থায় পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে গেলেও ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে৷ (আল-বাহরুর রায়িক: ২/৩০২)
-মসজিদের স্বাভাবিক নিয়মের বাইরে নিজ প্রয়োজনে মসজিদের লাইট, ফ্যান ব্যবহার করেছেন৷ মোবাইল চার্জ দিয়েছেন৷ ইতিকাফ শেষ করে বের হওয়ার সময় এই দশদিনের অতিরিক্ত বিল অনুমান করে মসজিদের দানবাক্সে দিয়ে আসবেন৷ এটা উত্তম ও সতর্কতার দাবি৷ যাতে মসজিদের কোনো হক আপনার জিম্মায় থেকে না যায়৷ (ফাতাওয়া রহীমিয়া: ৭/২৭৯)
-ইতিকাফ একটি খালিস ইবাদত৷ এর জন্য পারিশ্রমিক দেওয়া-নেওয়া কোনোটাই জায়েয নয়৷ তাই ইতিকাফ করার জন্য পারিশ্রমিক দিয়ে লোক বসানো জায়েয নেই৷ এর দ্বারা মহল্লাবাসী দায়মুক্ত হতে পারবে না৷
অর্থ: মূলনীতি হলো, প্রত্যেক ইবাদত যা মুসলিমদের জন্য খাস, এর উপর পারিশ্রমিক জায়েয নয়৷ (রদ্দুল মুহতার: ৬/৫৫, ফাতাওয়া মাহমূদিয়া: ১৫/৩৩৬)
-ফরয গোসল ব্যতীত ইতিকাফ অবস্থায় গোসল করা জায়েয নয়৷ শুধু গোসলের জন্য মসজিদ থেকে বের হলে ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে৷ তবে ইস্তেনজার প্রয়োজন সারতে গিয়ে যদি ওযুর বদলে কয়েক মগ পানি শরীরে ঢেলে দেয়, তাহলে অনুমতি আছে৷ (ফাতাওয়া মাহমূদিয়া: ১৫/২৭৭)
-জুমার দিনের সুন্নাত গোসল আদায়ের জন্যও ইতিকাফকারী মসজিদ থেকে বের হতে পারবে না৷ বের হলে ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে। -মসজিদে ওযু-ইস্তিনজার ব্যবস্থা না থাকলে নিজ ঘরে গিয়ে ওযু-ইস্তিনজা সেরে আসতে পারবে৷ (মাজমাউল আনহুর: ১/২৫৬)
ইতিকাফ থেকে বের হওয়ার অনুমোদিত শরয়ী প্রয়োজনগুলো কী কী?
(১) ইস্তিনজা তথা প্রস্রাব-পায়খানার জন্য বের হওয়া৷ (আহকামুল ইতিকাফ: ৩৬)
(২) জানাবত তথা স্বপ্নদোষের দ্বারা গোসল ফরয হওয়ার পর গোসলের জন্য ইতিকাফ থেকে বের হওয়া যাবে৷ (আহকামুল ইতিকাফ: ৩৬)
(৩) ওযু করার জন্য বের হওয়া যাবে৷ (আহকামুল ইতিকাফ: ৩৬)
(৪) বাহির থেকে অপর ব্যক্তি খাবার-দাবার নিয়ে আসার ব্যবস্থা না থাকলে নিজে গিয়ে আনার সুযোগ আছে৷ (আল-বাহরুর রায়িক: ২/৫৩০)
(৫) মুআযযিন সাহেব আযান দেওয়ার জন্য বের হতে পারবেন৷ তবে আযান শেষে সময়ক্ষেপণ করা যাবে না৷ (আল-মাবসূত; সারখাসী: ৩/১২৬, আহকামুল ইতিকাফ: ৩৬)
(৬) উত্তম তো হলো, এমন মসজিদে ইতিকাফ করা, যেখানে জুমা হয়৷ তবে তা যদি জামে মসজিদ না হয়, তাহলে জুমার নামায আদায়ের জন্য জামে মসজিদে যেতে পারবে৷ তবে কেবল এতটুকু সময় নিয়ে যাবে যে, পূর্বের চার রাকাত সুন্নাত নামায ও খুতবাসহ ফরয নামায আদায় করতে পারে৷ (ফাতাওয়া হিন্দিয়া: ১/২৭৫)
(৭) মসজিদ ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হলে বা জোর করে বের করে দিলে সাথে সাথে অন্য মসজিদে স্থানান্তরিত হলে ইতিকাফ ভঙ্গ হবে না৷ (আল-মুহীতুল বুরহানী: ৩/২৮০)
যে সমস্ত অবস্থায় ইতিকাফ ভঙ্গ করা জায়েয
(১) এমন অসুস্থতা দেখা দিলো যে, মসজিদ থেকে বের হয়ে ডাক্তারের কাছে চিকিৎসার জন্য যাওয়া জরুরি৷ তখন ইতিকাফ ভঙ্গ করা জায়েয৷
(২) কোনো মানুষ আগুনে পুড়ে যাচ্ছে অথবা পানিতে ডুবে যাচ্ছে, তাকে রক্ষা করার জন্য ইতিকাফ ভঙ্গ করা জায়েয আছে৷
(৩) মা-বাবা, সন্তানদের ভীষণ অসুস্থতার দরুন চিকিৎসার জন্য ইতিকাফ ভঙ্গ করা জায়েয।
(৪) মৃতের জানাযা উপস্থিত৷ জানাযার নামায পড়ানোর মতো আর কেউ নেই৷ তখন ইতিকাফ ভঙ্গ করা জায়েয আছে৷ (ফতহুল কাদীর: ২/১১১)
ইতিকাফের কাযা
এই সকল উজরের কারণে ইতিকাফ ভঙ্গ করা তো জায়েয আছে৷ তবে পরবর্তীতে এই ইতিকাফের কাযা আদায় করতে হবে৷ পুরো দশ দিনের ইতিকাফের কাযা করতে হবে না৷ শুধু একদিনের কাযা করে নিলেই হয়ে যাবে৷ কেননা প্রতিটি দিনের হুকুম স্বতন্ত্র৷ তাই যেদিন ইতিকাফ ভঙ্গ করা হয়েছে, কেবল সেদিনের কাযা করাই যথেষ্ট৷ (ফাতাওয়া তাতারখানিয়া: ২/৪১৪, রদ্দুল মুহতার: ২/৪৪৪)
যে সকল কারণে ইতিকাফ মাকরুহ হবে
(১) ইতিকাফে একেবারে চুপচাপ থাকা মাকরুহ। সওয়াব মনে করে নিরবতা ব্রত পালন করলে বিদআত হবে৷ কেননা নিরব থাকা কোনো ইবাদত নয়। তবে অনর্থক ও গোনাহের কথা থেকে বেঁচে থাকার নিমিত্তে নিরবতা অবলম্বন নিন্দনীয় নয়৷
(২) অনর্থক ও বেহুদা কথাবার্তা বলাও মাকরুহ৷ তবে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলা জায়েয৷
(৩) ব্যবসার পণ্য মসজিদে এনে বিক্রয় করাও মাকরুহ৷
(৪) ইতিকাফে এত বেশি জায়গা দখল করে বসা যে, অন্য ইবাদতকারীদের কষ্ট হয়৷ এটাও মাকরুহ৷
নারীদের ইতিকাফ
ইতিকাফের বিধান ও ফযীলত শুধু পুরুষদের জন্য নয়, নারীরাও এই ফযীলত অর্জন করতে পারবে৷ তবে তাদের মসজিদে ইতিকাফ করা উচিত নয়৷ বরং ঘরেই তাদের ইতিকাফ হতে পারে রাসুলুল্লাহ ﷺ-এর পূণ্যবতী স্ত্রীগণ ইতিকাফ করতেন। উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন অর্থ: নবীজী ﷺ আমৃত্যু রামাযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করেছেন। তার মৃত্যুর পর তার স্ত্রীগণ ইতিকাফ করেছেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস নং-২০৩৬; সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-১১৭২) আমাদের দেশে নারীরা খুব কমই ইতিকাফ করেন।
অথচ ইতিকাফ অত্যন্ত সওয়াব ও ফজিলতের কাজ এবং নারীদের জন্য তা খুব সহজও বটে। কারণ তারা ঘরেই ইতিকাফ করবেন। নিয়ম মেনে সংসারের খোঁজখবরও নিতে পারবেন। সংসার ঠিক রেখে তাদের ইতিকাফও হয়ে যাবে। সুতরাং এমন সুযোগ হাতছাড়া করা মোটেই উচিত নয়। নারীদের মধ্যে ইতিকাফের ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টি হওয়া উচিত। পুরুষদের উচিত নারীদের ইতিকাফের জন্য উদ্বুদ্ধ করা এবং সুযোগ তৈরি করে দেয়া। তাহলে পুরুষরাও সওয়াব পাবেন।
নারীরা কোথায় ইতিকাফ করবেন?
নারীদের মসজিদে ইতিকাফে বসা উচিত নয়৷ তাছাড়া নারীদের বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ঘরে অবস্থানের নির্দেশ দেয়া হয়েছে৷ আর নারীদের জন্য ইতিকাফ করা জরুরি কোনো আমল নয়। তবে ফযীলতের আমল হিসেবে নিরুৎসাহিত করাও উচিত নয়৷
অর্থ: তোমরা (মুসলিম মহিলাগণ) নিজ গৃহে অবস্থান করবে৷ (সূরা আল-আহযাব: ৩৩)
অর্থ: ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন- নবী করীম ﷺ ইরশাদ করেন- নারীদের ঘরে নামায আদায় করা বৈঠকখানায় নামায আদায় করার চেয়ে উত্তম। নারীদের থাকার ঘরে নামায আদায় করার চেয়ে গোপন কুঠুরিতে নামায আদায় করা অধিক উত্তম। (আবু দাউদ হাদীস নং- ৫৭০, তিরমিযী হাদীস নং-১১৭৩)
রাসূলুল্লাহ ﷺ জীবদ্দশায় যেখানে নারীদের ঘরকে মসজিদ থেকে উত্তম বলা হয়েছে, তাহলে এ যুগে এসে রাসূলের শিক্ষার বিপরীত গিয়ে ডাকাডাকি করে মুসলিম নারীদের ঘর থেকে বের করে মসজিদে নিয়ে যাওয়া কতটুকু সঠিক পন্থা হিসেবে বিবেচিত হবে? পক্ষান্তরে উম্মুল মুমিনীনের বক্তব্য এ ব্যাপারে আরো পরিষ্কার৷
অর্থ: আয়িশা রাযি. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, যদি রাসূলুল্লাহ ﷺ বর্তমান কালের নারীদের অবস্থা দেখতেন, তাহলে অবশ্যই তাদেরকে মসজিদে আসতে নিষেধ করতেন। যেমন নিষেধ করা হয়েছিল বনি ইসরাইলের নারীদেরকে। ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ বলেন- আমি আ’মরা রাহ.-কে বললাম, তাদেরকে কি নিষেধ করা হয়েছিল? তিনি বললেন, হ্যাঁ।
(সহীহ বুখারী হাদীস নং-৮৩১, সহীহ মুসলিম হাদীস নং-৪৪৫)
অপর এক বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ ﷺ ইরশাদ করেন- অর্থ : মহিলাদের জন্য সর্বোত্তম মসজিদ হলো তাদের বাড়ির গোপন প্রকোষ্ঠ৷ (মুসনাদে আহমদ হাদীস নং-২৬৫৪২)
আয়িশা রাযি. বলেন: রামাযানের শেষ দশকে নাবী ﷺ ইতিকাফ করতেন। আমি তাবু তৈরী করে দিতাম। তিনি ফজরের সালাত আদায় করে তাতে প্রবেশ করতেন। (নবী সহধর্মিণী) হাফসা রাযি. তাঁবু টানানোর জন্য আয়িশা রাযি. এর কাছে অনুমতি চাইলেন। তিনি অনুমতি দিলে হাফসা রাযি. তাবু টানালেন। (নবী সহধর্মীণী) যয়নাব বিনতে জাহশ রাযি. তা দেখে আরেকটি তাবু তৈরি করলেন। সকালে নবী ﷺ তাবুগুলো দেখলেন।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন এগুলো কি? তাকে জানানো হলে তিনি বললেন: তোমরা কি মনে কর এগুলো দিয়ে নেকি হাসিল হবে? এ মাসে তিনি ইতকিাফ ত্যাগ করলেন এবং পরে শাওয়াল মাসে ১০ দিন (কাযা স্বরূপ) ইতিকাফ করেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং-২০৩৩)
এই বর্ণনা থেকে বোঝা গেলো, রাসূলুল্লাহ ﷺ নারীদের মসজিদে এসে ইতিকাফ করা পছন্দ করতেন না৷ যার কারণে এ বছর তিনি ইতিকাফ করাই ত্যাগ করলেন৷
মুল্লা আলী কারী রাহ. লিখেন-
অর্থ: (হাদীসে যে এসেছে) ‘এরপর রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সহধর্মিণীগণ ইতিকাফ করেছেন’ এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, তাঁরা নিজেদের ঘরে ইতিকাফ করেছেন৷ কেননা পূর্বে আলোচনা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ ﷺ উম্মাহাতুল মুমিনীনের মসজিদে ইতিকাফের বিষয়টি রাসূলুল্লাহ ﷺ অপছন্দ করেছেন৷ (মিরকাতুল মাফাতীহ: ৪/১৪৪৬)
-নারীরা ইতিকাফ করার ক্ষেত্রে তাদের পিরিয়ডের হিসাব মাথায় রাখবেন৷ যাতে মধ্যখানে ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে না যায়৷
-নারীরা স্বামীর অনুমতি নিয়ে ইতিকাফে বসবেন৷ অনুমতি ছাড়া ইতিকাফে বসা জায়েয নয়৷ (ফাতাওয়া হিন্দিয়া: ১/২১১)
লেখক: ইমাম ও খতিব, আম্বরখানা কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ