ইসলামোফোবিয়া কি এবং কারা ছড়াচ্ছে এর বিষ?
- আপডেট সময় : ০৫:১২:৩১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৯ অক্টোবর ২০২০ ৯০ বার পড়া হয়েছে
ফ্রান্সে মহানবী সাঃ এর ব্যঙ্গ চিত্র প্রকাশের পরে, প্রকৃত প্রস্তাবে অনেক আগে থেকেই ইসলামোফোবিয়ার সাথে মুসলমানদের নিত্য বসবাস। কিন্তু, আতঙ্কের বিষয় হল মুক্ত চিন্তার উর্বর দিনেও ‘ইসলাম বিদ্বেষ’ প্রতিদিনের শিরোনাম হয়। ইউরোপীয়রা এ কাজে সবচেয়ে পটু। তারা প্রতিদিনই নতুন মোড়কে পরিবেশন করছে তাদের মুসলিম-বিরোধী মনোভাব। সাম্প্রতিক কালে ফ্রান্সের মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে মহানবী সাঃ কে কটাক্ষ করায় ইসলামোফোবিয়া নতুন করে সামনে আসে।
ইসলামোফোবিয়া (Islamophobia) কি?
ইংরেজি ভাষার বিখ্যাত অভিধান মিরিয়াম অয়েবস্টার’র মতে, ফোবিয়া (phobia) অর্থ হল বাড়াবাড়ি, কোন বস্তুর প্রতি অযৌক্তিক ও অনির্বচনীয় ভয় বা নিরর্থক আতঙ্ক। অক্সফোর্ড ডিকশনারির মতে, ইসলামোফোবিয়া হল ইসলামের প্রতি ভয় ও পক্ষপাতদুষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি, বিশেষ করে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ইসলামকে মেনে না নেয়ার প্রয়াস। অনলাইন মুক্ত বিশ্বকোশ উইকিপিডিয়া’র মতে ইসলামোফোবিয়া হল ইসলাম ও মুসলমানদেরকে ভয়, ঘৃণা ও অযৌক্তিক মুল্যায়ন। মূলত ‘ইসলামোফোবিয়া’ শব্দটি মুসলমানদেরকে খাটো করার উদ্দেশ্যে, নিন্দার্থে বা ব্যাঙ্গার্থে ব্যবহৃত করা হয়, যার সরল অর্থ হল ইসলামকে ভয় করা।
কারা ছড়াচ্ছে এর বিষ?
ইসলামোফোবিয়া বহুবছর যাবত ইউরোপীয় দেশগুলোর দীর্ঘ দিনের মানসিক রোগ যার ফলে তাদের জোটগত বস্তুগত আচরণ এবং বিদ্বেষ। মুক্তচিন্তা চর্চার নামে ইসলামকে খাটো করার পেছনে মূলত কাজ করছে ইসলামকে বিকৃত করার অভিপ্রায়। ফ্রান্স ও পশ্চিমের দেশ গুলো এ কাজের নেতৃত্ব দিলেও প্রাচ্য দেশিও অনেক দল ও সংগঠন আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে আছে এর সাথে।
- ডানপন্থী ইভানজেলিক খ্রীস্টান (Right Wing Christian Evangelical Groups)
ক্রিস্টানদের একটি অংশ যারা ডানপন্থী ইভানজেলিক খ্রীস্টান বলে পরিচিত তারা সরাসরি তাদের ধর্মীয় বক্তৃতায় মুসলমানদেরকে তুলে ধরে পৌত্তলিক নাস্তিক ‘ অখ্রীস্টান’ এবং ইসলামকে ‘আপদ’ হিসেবে। তাদের মতে মুসলমানদের ইউরোপে আগমন ও ধর্ম প্রচার ইউরোপীয় সভ্যতার হুমকি। এভাবে ইসলামোফোবিয়া হয়ে দাড়ায় ডানপন্থী ইভানজেলিক খ্রীস্টানদের একটি সিস্টেমেটিক পদক্ষেপ ‘পৌত্তলিক’ ও ‘আপদ’র বিরুদ্ধে। নিউজিল্যান্ডের খ্রাইস্টচার্চের ঘটনাটাই দেখুন। গত বছরের মার্চে খ্রাইস্টচার্চ মসজিদে ২৫ বছর বয়সি অস্ট্রেলিয়ান শ্বেতাঙ্গ ব্রেন্টন টরেন্ট ৪৯ জনকে গুলি করে হত্যা করে। ব্রেন্টন টরেন্ট অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে এ হত্যাযজ্ঞটি চালায়। গুলি ছোঁড়ার আগে সে ইউরোপ ও আমেরিকাকে অভিবাসী মুক্ত খাঁটি সাদাদের দেশ বানানোর উদাত্ত আহ্বান জানায়। তার এই বক্তব্যটি ছিল হোয়াইট আধিপত্যবাদীদের ‘মনের কথা’।
- ইহুদি আধিপত্যবাদী এবং তাদের সমর্থকরা (Jewish Supremacists and Their Supporters)
ইহুদিরা আদিকাল থেকেই মুসলমানদেরকে তাদের বিকাশের অন্তরায় ভেবে আসছে, যারা দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর ব্রিটেনের সহায়তায় ফিলিস্তিনিদের ঘাড়ে চেপে বসে। ইহুদিদের আগ্রাসনের প্রতিবাদে মুসলমানরা শুরু থেকেই জায়নবাদের (ইসরায়েলকে ইহুদি রাষ্ট্রে পরিনত করার আন্ধোলন) বিরোধিতা করে আসছে। ইসলামোফোবিয়া তাই ইহুদিদের প্রধান হাতিয়ার মুসলমানদের যৌক্তিক দাবীকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য। ইহুদিদের এ কাজে সরাসরি সমর্থন দেয় ইউরোপ ও তাদের বহুজাতিক কর্পোরেশন গুলো। তারা আরব ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রচার করে এবং দাবি করে যে মুসলিমরা ইহুদী ও ইহুদী বিরোধী। ইউরোপে ইহুদী লবিং ও মিডিয়া মুসলমানদের বিরুদ্ধে অবিরত অপপ্রচার চালায়। মার্কিন সিনেটর থেকে থেকে শুরু করে হলিউড অভিনেতা – সবাই ইসলামোফোবিয়ার বিষ ছড়াতে অবদান রাখে।
- হোয়াইট আধিপত্যবাদী (White Supremacists)
যারা সব কিছু বিচার করে সাদা-কালোর ভিত্তিতে। তারা সব অঞ্চলের মুসলমানদেরকে কালোদের অংশ হিসাবে বিবেচনা করে এবং এমনকি যারা ককেশীয় অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করে তারাও সাদা বলে দাবি করতে পারে না। তারা বিশ্বাস করে যে ইশ্বর হোয়াইট রেসের পক্ষে আছেন। হোয়াইট আধিপত্যবাদীদের মতে যারা কালোদের সাথে সম্পর্ক রাখে তারাও কালো। গ্রীক বীর আলেকজান্ডার যখন সিরিয়া-মিশর-ইরান জয় করে অতি উৎসাহে এশিয়াকে হেলেনিক করে তোলার উদ্দেশ্যে ইরানী কন্যাদের সাথে গ্রীক বীরদের গনহারে বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত সেই আলেকজান্ডারও পাশ্চাত্যের দৃষ্টিতে হারিয়ে গেলেন ‘প্রাচ্য বীর’ হিসেবে।
- হিন্দুত্ববাদী আধিপত্যবাদী (Hindutva Supremacists)
তারা বিশ্বাস করে যে ইশ্বর কেবল তাদের জন্যই আছেন ফলে অন্যরা তাদের চোখে (Dalit) অস্পৃশ্য। মুসলমানদের প্রতি তাদের মুল্যায়ন ভয়ানক। হিন্দুত্ববাদীরা ভারতবর্ষের মুসলমানদেরকে হানাদার হিসেবে দেখে যেখানে তারা ব্রিটিশদের ব্যপারে এরকম ধারনা রাখে না। এবং তাদের বিশ্বাস যাদের মুসলমানদেরকে অবশ্যই হিন্দু ধর্মে ফিরে যেতে হবে। ভারত সাম্প্রতিক কালে CAA প্রনয়ন করে, যার মাধ্যমে মুসলমানদের সংখ্যা কমানোর চেষ্টা চালানো হবে। ইসলামভীতি তাদের মধ্যে এমনভাবে ঝেঁকে বসেছে যে তারা তাজমহলকে হিন্দু মন্দির হিসেবে প্রমাণ করায় ব্যস্ত। তারা লাভ জিহাদ, নওকর জিহাদ (সরকারী চাকরিতে মুসলমানদের অংশগ্রহন), করোনা জিহাদ নামে বিভিন্ন শব্দ দিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াচ্ছে। সাম্প্রতিক কালে সারা বিশ্ব যখন ফ্রান্সের সমালোচনায় মুখর, ভারতে তখন হিন্দুত্ববাদীরা ফ্রান্সের সমর্থনে #IStandWithFrance এবং #WeStandWithFrance প্রচারনা শুরু করে।
- বৌদ্ধ আধিপত্যবাদী (Buddhist Supremacists)
যারা গৌতম বোদ্ধের ‘জীব হত্যা মহাপাপ’ বাণী প্রচার করে, মুসলিম নিধন তাদের কাছে হয়ে যায় অতি প্রিয় কাজ। বৌদ্ধ আধিপত্যবাদীরা বিশ্বাস করে পৃথিবীর সকল প্রাণীর নিরাপত্তা ও বেঁচে থাকা নিশ্চিত করা ওদের ধর্মীয় দায়িত্ব। যেভাবে মিয়ানমারকে মুসলিম উপস্থিতি থেকে বাঁচানো ও উইঘুর মুসলমানদের মানবিক ও ধর্মীয় অধিকার কেড়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্ধী রাখা তাদের ধর্মীয় দায়িত্ব।
- ডানপন্থী এবং বহুজাতিক কর্পোরেশন নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া (Right wing and multinational corporation-controlled media)
যারা রাস্তায় নিরীহ মানুষের ছড়িয়ে পড়া রক্ত দেখতে পছন্দ করে যাতে তার প্রতিবেদকরা রগরগে ও বিভাজনমূলক প্রতিবেদনের মাধ্যমে এটি আরও বিজ্ঞাপন এবং রেটিং এর উপযোগী বানাতে পারে। মধ্যপ্রাচ্ছ্যের যুদ্ধরত দেশগুলো তাই সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের প্রতিভা ও বিবেক দেখানোর উর্বর জমি। মধ্যপ্রাচ্চ্যের দেশগুলোতে যারা অস্ত্র সরবরাহ করে তারাই নিউজ্রুমে বসে যুদ্ধ বিরোধী বয়ান দেয়। ভারতের অধিকাংশ প্রথম সারির টিভি চ্যানেল যারা সেদেশে “গোদি মিডিয়া” নামে পরিচিত। গোদি মিডিয়া সবসময় টিভিতে সাম্প্রদায়িক খবর প্রকাশ করে। গো হত্যার নামে মুসলমান হত্যা তাই সেখানে মিডিয়া সমর্থন পায়। মুসলিম ও হিন্দু প্রেমকে তারা লাভ জিহাদ ট্যাগ দিয়ে প্রাইম টাইম নিউজ প্রচার করে। ফেসবুক দীর্ঘদিন পর্যন্ত বিজেপির মুসলিম বিদ্বেষমূলক পোস্ট সেন্সর করেনি। কারন সংখ্যাগরিস্ট হিন্দুরা এতে জড়িত। এবং বিজ্ঞাপনের একটা বিশাল অংশ আসত বিজেপি ও কট্টর হিন্দুত্তবাদী সংগঠনগুলো থেকে।
- উদারপন্থী বাম(Liberal left)
যারা ইসলামকে মানব সভ্যতার অবরুদ্ধ বলে মনে করে। কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের মতে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবিরা একটু ইসলামোফোবিক। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মুক্তমনাদের কাছে মুক্তচিন্তা মানে কেবল ইসলামের বিরোধিতা করা। সারা বিশ্বের সব কথাসাহিত্যিক যার কোটের পকেটে থাকেন তিনি ম্যাক্সিম গোরকি। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর পকেটে পাওয়া গিয়েছিল যে বই সেটি হল ইসলামের নবী মুহাম্মদ সাঃ এর জীবনী। উদারপন্থী বামরা এখান থেকে কবে শিখবে?
এটা মিথ্যে নয় আই এস ও কিছু উগ্রবাদী মুসলমান (যারা মানুষ মেরে খেলাফত কায়েম করাকে ইসলাম মনে করে) শান্তিপ্রিয় মানুষের মনে আতঙ্ক ডুকিয়ে দিচ্ছে, কিন্তু ইসলামোফোবিয়াকে আন্তর্জাতিককরনে অন্যদের অবদান সবচেয়ে বেশি।
লেখকঃ ইংরেজি প্রভাষক, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ।
[নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্ত ব্যাক্তিগত। “সিলেটের টাইমস” কর্তৃপক্ষ কোনভাবেই দায়ী নয়। – সম্পাদক]