সমাজ কল্যাণে ছাত্র সমাজ
- আপডেট সময় : ০৫:৫৮:৪৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৪ মে ২০২৩ ১৮৪ বার পড়া হয়েছে
ছাত্রজীবন মানব জীবনের প্রস্তুতিকাল। ছাত্রজীবনের ভিত্তির উপর ধীরে ধীরে মানবজীবনের কর্ম কৃতিত্বের সৌধটি গড়ে ওঠে। এই ভিত্তি সুদৃঢ় হবে, ভবিষ্যতে জীবন ও তত বলিষ্ঠ এবং সমৃদ্ধ হবে। মানব জীবনের ভিত্তি সুদৃঢ় করতে হলে ছাত্রজীবনে যতœবান হতে হবে।তাই ছাত্রজীবনে লেখাপড়াও খেলাধুলার সঙ্গে সঙ্গে যেমন শরীর ও চরিত্র গঠন করতে হবে, তেমনি জগৎ ও জীবনের বহু বিচিত্র কর্মধারার সঙ্গে পরিচয় সাধন করতে হবে। এই পরিচয় সাধনের সূত্রই ছাত্রজীবনে সমাজকল্যাণ অথবা সমাজসেবা।
সভ্যতার প্রথম উন্মেষ কালে আগুন আবিষ্কারের পরই সমাজ গঠন বোধকরি মানব সভ্যতার অন্যতম অবদান। তারপর থেকে সভ্যতার অগ্রগতি ও ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষ কতগুলি অলিখিত নিয়ম কানুন ও রীতিনীতি সূত্রে একে অন্যের সঙ্গে পরস্পর গাঁতা হয়ে পৃথিবীর এক এক অঞ্চলে একত্রে বসবাস করতে আরম্ভ করলো। এই ভাবেই একদিন সুসভ্য মানুষের সমাজ গড়ে উঠলো। সমাজের উদ্ভবের প্রথমদিন থেকেই মানুষ সমাজ সেবায় প্রয়োজন অনুভব করে। আজ সভ্যতার চরম উৎকর্ষের দিনেও মানব সমাজে এই সেবা ও সহযোগিতার প্রয়োজন এতটুকু কমেনি। সুতরাং সমাজসেবা বলতে সমাজের অন্তর্গত মানুষের সেবা ও কল্যাণকেই বোঝায়।
সমাজসেবার প্রয়োজন সব দেশে থাকলেও ভারতবর্ষের মতো দরিদ্র উন্নয়নশীল বিশাল দেশে এর গুরুত্ব সমাধি। ১০০ কোটি জন অধ্যুষিত এই বিশাল দেশের কোটি কোটি মানুষ নিদারুণ দুঃখ দুর্দশা ও অভাব-অনটনে নিপীড়িত। দেশের অনেক মানুষই আজও নিরক্ষরতার নিবিড় অন্ধকারে নিমজ্জিত। এর ওপর আছে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঝড়-ঝঞ্ঝা খরা, বন্যা, ভূমিকম্প, ও দুর্ভিক্ষ মহামারীর তান্ডব লীলা। বলা বাহুল্য, এদেশে এসব সমস্যার ও দুর্যোগ এর মোকাবিলা করার প্রাথমিক দায়িত্ব দেশের সরকারের বিশেষত আমাদের দেশে যখন জনকল্যাণমুখী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু কী অর্থে ,কি সামর্থ্যে এই বিরাট সমস্যার সমাধান করা রাষ্ট্রশক্তির একার পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। সেই দিক দিয়ে এদেশের সমাজ সেবার গুরুত্ব অপরিসীম।
এদেশের সমাজসেবার সমস্যাটির যেমন গরিষ্ঠ তেমনি এর ক্ষেত্রটি ও বহুদূর বিস্তৃত। এই বিশাল ক্ষেত্রে সমাজ সেবায় অংশগ্রহণ করবে কে বা কারা? অবশ্য সরকারের ভূমিকায় এতে অগ্রগণ্য ,কিন্তু দেশের অসংখ্য জনহিতকর সেবা প্রতিষ্ঠান গুলির ভূমিকা ও এতে নগণ্য নয়। সমাজসেবামূলক এই প্রতিষ্ঠান গুলির মধ্যে রামকৃষ্ণ মিশন, ভারত সেবাশ্রম, মাড়োয়ারি রিলিফা সোসাইটি, রেড ক্রস, সেন্ট জনস্ অ্যাম্বুলেন্স প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য এবং তাদের অবদান তাদের অকুণ্ঠ ও নিরলস জনসেবা প্রশংসনীয়। তবে সমাজসেবার বিশাল ক্ষেত্র ও বিপুল গুরুত্বের তুলনায় এই সেবা উল্লেখযোগ্য হলেও পর্যাপ্ত নয়।সমাজসেবার দায়িত্ব পালন ও গুরু ভার বহনের জন্য তাই প্রয়োজন বৃহত্তর শক্তির।
তাই শুধু স্বাভাবিকভাবে নয়, প্রয়োজনের কারণে ও দেশের সুবিশাল ছাত্রসমাজের সুবিপুল কর্মশক্তির ওপর সমাজসেবার অংশগ্রহণের কথা এসে পড়ে। এখানে ও সমাজ সেবায় ছাত্র দের সম্পর্ক। ছাত্রসমাজ শুধু শক্তি মান নয়,সমাজসেবার কাছে তারা যোগ্য ও উপযুক্ত ও বটে। কারণ সমাজ সেবার জন্য যে সময় এবং শ্রম এর প্রয়োজন, আগ্রহ থাকলেও নানান সমস্যায় নিত্য বিব্রত কর্মজীবী সংসারী মানুষ তা দিতে পারে না। আপাতত দৃষ্টিতে অসম্ভব হলেও দেশের ছাত্রসমাজই সমাজসেবার মহান দায়িত্ব পালনে সময় ও শ্রম নিয়োগ করতে সক্ষম।অসীম প্রাণশক্তিতে উদ্বেল, অফুরন্ত উৎসাহে চঞ্চল, উচ্ছৃসিত আনন্দে ভরপুর তাজা তরুণ ছাত্র সমাজ তাই যেকোনো দুঃসাহসী কাজে নিঃস্বার্থ পরোপকারিতায় ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য সদাই উন্মুখ। লেখাপড়া ও খেলাধুলা করেও ছাত্রদের যে উৎসাহ উদ্বৃত থাকে তাকেই সমাজসেবার কাজে নিয়োজিত করতে হবে। ছাত্রজীবনে সমাজসেবার এই গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনা করেই আমাদের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রমে সমাজসেবাকে পাঠ্য ও আচরণীয় বিষয় হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে
দেশের সমাজসেবার ক্ষেত্রটি যেমন বহুবিস্তৃত, সমস্যাগুলি যেমন বহু মুখী, দেশের বিরাট ছাত্রসমাজ ও তেমনি বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে শহর ও গ্রামের নানাপ্রকার সেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ করতে পারে। যে নিরক্ষরতা উন্নয়নশীল ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় অভিশাপ, সমাজসেবার অঙ্গরূপে সেই নিরক্ষরতা দূরীকরণে ছাত্র দের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য। পল্লী প্রধান এই দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমস্যা পল্লীসংস্কার। সুতরাং সমাজসেবায় বিষয় রূপে ছাত্র দের পল্লী সংস্কারে অংশগ্রহণ করতে হবে। পল্লী উন্নয়ন ছাত্র দের কাজ হবে পল্লীর পথঘাট নির্মাণ, জীর্ণ পুকুরের সংস্কার সাধন, পানীয় জলের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি। তাছাড়াও অজ্ঞ ও উদাসীন গ্রামবাসীদের স্বাস্থ্যবিধি পালনে সচেতন করে তোলা, ক্ষতিকর সংস্কার পরিহারে উৎসাহিত করা, তাদের আচরণে নাগরিকতা বোধ গড়ে তোলা সমাজসেবার অন্তর্গত।
এসব কাজে ছাত্রছাত্রীরা অঞ্চলে অঞ্চলে পাঠাগার ও প্রদর্শন কেন্দ্র স্থাপনের ব্যবস্থা করে এবং নিজেরা নাটক অভিনয় করে, সিনেমা দেখিয়ে ও ঘরোয়া আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে গ্রামবাসীদের উৎসাহিত উদ্বুদ্ধ করতে পারে। সবার শেষে উল্লেখযোগ্য হলো প্রাকৃতিক বিপর্যয় সমাজ সেবার গুরুত্ব। এ কাজে এই ছাত্রদের স্বতঃস্ফূর্ত উৎসাহ ও অসামান্য তৎপরতা। ঝড় বন্যা ভূমিকম্প প্রভৃতি যখন লক্ষ লক্ষ মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে অসহায় ভাবে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে, তখনই তাদের পাশে ছাত্রদের এগিয়ে আসতে হবে সেবা ও সাহায্যের হাত প্রসারিত করে। এককথায় আত্মত্রাণ এ সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে ছাত্র সমাজকে। বলাবাহুল্য, সমাজসেবার এই বহুবিধ কাজে ছাত্রদের সুপরিকল্পিতভাবে পরিচালিত না করলে সমাজসেবার সফলতা ও সার্থকতা সুদূর পরাহত।
সমাজ সেবার ফলে শুধু সমাজের কল্যাণ সাধিত হয় না, সমাজ সেবার মাধ্যমে ছাত্ররা যথেষ্ট আনন্দ লাভ করে এবং উপকৃত হয়। সমাজসেবার মধ্য দিয়ে ছাত্রদের মনে নিজেদের কর্মশক্তির উপর বিশ্বাস জন্মায়, জীবনে যে কোনো বিপদের সম্মুখীন হওয়ার মতো সাহস অর্জন করে ছাত্ররা। মানুষের সেবায় ও কল্যাণে নিযুক্ত হতে পারে তারা উৎসাহিত হয়, এক অপার্থিব তৃপ্তিতে তাদের হৃদয় ভরে যায়। এই প্রসঙ্গে ছাত্রদের মনে রাখতে হবে, মানবপ্রেম ও মানব সেবার মূলমন্ত্র। সেই প্রেম প্রীতির আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ছাত্রসমাজকে সমাজ সেবায় ব্যাপক ভুমিকা রাখতে হবে!
লেখক- গবেষক, কলামিস্ট, মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান, পাঠান পাড়া, (খান বাড়ী) কদমতলী, সদর, সিলেট-৩১১১, মোবাঃ ০১৯৬৩৬৭১৯১৭