সরকারি নীতি বিরোধী এবং হাইকোর্ট অবমাননাকারী চক্রের বিশেষ স্টিকারে চলছে ইজিবাইকঃ দেখার যেন কেউ নেই
- আপডেট সময় : ০৩:৫১:৫৩ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৭ জুলাই ২০২১ ৫৫ বার পড়া হয়েছে
বিশেষ সংবাদদাতাঃ সিলেট-সুনামগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের জাউয়াবাজার একটি ব্যস্ততম বাজার এলাকা। শুধু তাই নয়, সুনামগঞ্জের ছাতক শিল্প শহরের পরেই এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্রও বটে। রাজধানী ঢাকা, চট্ট্রগ্রাম, কুমিল্লা, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, ময়মনসিংহ, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সিলেট হয়ে সুনামগঞ্জ পৌঁছার মাধ্যমও জাউয়াবাজার। প্রতিদিন জাউয়াবাজার হয়ে বিশালাকৃতির যানবাহনগুলো সিলেট-সুনামগঞ্জ যাতায়াত করে থাকে। অথচ গুরুত্ববাহী এই বাণিজ্যকেন্দ্রের অভ্যন্তরের সড়কটি দীর্ঘদিন খানাখন্দে ভরপুর থাকায় যাত্রী সাধারণ এবং স্থানীয় পথচারীদের অশেষ দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। সম্প্রতি সরকারের পরিকল্পণামন্ত্রী এম এ মান্নান এবং স্থানীয় এমপি মুহিবুর রহমান মানিকের সুদৃষ্টির ফলে ইতোমধ্যেই সড়কটি প্রশ্বস্তকরণ ও পুনঃসংস্কার করা হয়েছে। এ কারণে বর্তমানে সড়ক ব্যবহারকারীদের দুর্ভোগ কিছুটা হলেও লাঘব হয়েছে।
তবে নতুন করে শুরু হয়েছে আরেক যন্ত্রণা। সরকারিভাবে নিষিদ্ধ ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক নামীয় রিক্সাজাতীয় এক ধরণের বাহন, যা স্থানীয়ভাবে টমটম নামে পরিচিত এবং ব্যাটারিচালিত রিক্সার দৌরাত্বে এ সড়কে নির্বিঘ্নে যাতায়াত অসম্ভব হয়ে পড়েছে। অবৈধ এই বাহনের যত্রতত্র পার্কিং এবং বেপরোয়া চলাচলের কারণে প্রায় প্রতিদিনই জাউয়াবাজারে ঘটছে ঘটনা-দূর্ঘটনা। অথচ সরকারের পাশাপাশি উচ্চ আদালতও এই বাহনকে অবৈধ হিসেবে সড়কে চলাচলের অনুপযোগী ঘোষণা করে এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু মন্ত্রীর দোহাই দিয়ে, ক্ষমতাসীন দলের নাম ভাঙিয়ে, প্রশাসনের মাথার উপর ছড়ি ঘুরিয়ে একটি স্বার্থান্বেষী চাঁদাবাজচক্র নির্বিঘ্নে জাউয়াবাজারে এসব অবৈধ ইজিবাইক ও ব্যাটারিচালিত রিক্সাকে সুদৃশ্য ও মনোরম স্টিকার লাগিয়ে বৈধতা প্রদান করে যাচ্ছে। যা সরকারের সড়ক পরিবহন শৃংখলানীতি পরিপন্থী এবং ‘উচ্চ আদালত অবমাননা’ বলে বিশেষজ্ঞরা আখ্যায়িত করেছেন। আর জাউয়াবাজারে এই সরকার বিরোধী ও আদালত অবমাননাকর অপকর্ম করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন রেজা মিয়া তালুকদার নামে ক্ষমতাসীন দলের এক নেতার নেতৃত্বে একটি চক্র। এই চক্রের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে খুন, হত্যা, হত্যাপ্রচেষ্টা, অবৈধ দখলবাজি, চাঁদাবাজি, জুয়া খেলাসহ নানা অপরাধে বিভিন্ন মামলার আসামী গোলাম মুক্তাদির (৪২), হীরক মিয়া (৩৮), লোকমান মিয়া (৩৮)সহ আরো কয়েকজন চিহ্নিত অপরাধী। অভিযুক্ত লোকমান স্থানীয় খিদ্রাকাপন গ্রামের মৃত রশীদ মিয়ার ছেলে, হিরক একই গ্রামের মৃত খালিক মিয়ার ছেলে এবং মুক্তাদির জাউয়া গ্রামের মৃত চান মিয়ার ছেলে। এরা প্রত্যেকেই নিজেদের ক্ষমতাসীন দল এবং ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের নেতা হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। আর এদের গডফাদার হিসেবে রয়েছেন যুক্তরাজ্য প্রবাসী কথিত যুক্তরাজ্য যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, ছাতক উপজেলার খিদ্রাকাপন গ্রামে উকিল আলীর ছেলে মাহমুদ আলী। যার বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্যে মানিলন্ডারিং ও মাদক ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে। সুনামগঞ্জ জেলা ও ছাতক উপজেলা আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতাদের কাছে রেজা মিয়া, মুক্তাদির বা এদের গডফাদার মাহমুদ আলী সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা বলেন, ‘এ নামে আমাদের দলে কেউ নাই। এদের কে আমরা চিনি না। কোন অপরাধী যদি আমাদের দলের নাম ভাঙ্গিয়ে স্বার্থ হাসিলে লিপ্ত থাকে, সাধারণ মানুষকে হয়রাণী করে থাকে বা অন্যায়ভাবে জনদূর্ভোগ সৃষ্টি করে, তবে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে আমাদের কোন আপত্তি নেই। পাশাপাশি সত্যি যদি আমাদের দলের সাথে তাদের কারো বিন্দু পরিমাণ সম্পর্ক থাকে, তবে আমরা সাংগঠনিকভাবেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কার্পণ্য করবো না।’
সরেজমিন অনুসন্ধানকালে দেখা গেছে, ব্যস্ততম জাউয়াবাজারে প্রায় প্রতিদিনই যানজট লেগে থাকে। আর এ যানজট সৃষ্টির মূল কারণ সড়কের ওপর অবৈধভাবে গড়ে উঠা কয়েকটি অবৈধ স্ট্যান্ড। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করে উপরোক্ত রেজা মিয়া, লোকমান মিয়া, হীরক মিয়া, গোলাম মুক্তাদিরসহ আরো কয়েকজন। এ চক্রটি প্রতিটি ইজিবাইক বা টমটম থেকে ৫শ’ টাকা করে চাঁদা নিয়ে রেজা মিয়া নামাঙ্কিত একটি বিশেষ স্টিকার বাহনে লাগিয়ে দেয়। কিন্তু স্থানীয় ফাঁড়ীর পুলিশ ও ট্রাফিক সার্জেন্টরা এদের আটক করলেও চক্রটি দলবদ্ধ হয়ে পুলিশের সাথে হৈ-হল্লা করে আটক টমটম অনেকটা জোরপূর্বক ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। পুলিশ অবৈধ টমটমের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে বা অভিযান চালিয়েও এদের প্রতিরোধ করতে পারছে না বলে অভিযোগ করেছে। পুলিশ বলেছে, মহাসড়কে এসব বাহন চলাচল অবৈধ হবার পরও সুনামগঞ্জের জাউয়াবাজারে ক্ষমতাসীন দলের নাম ভাঙ্গিয়ে একটি চক্রের দেয়া ‘বিশেষ স্টিকারের ক্ষমতাবলে’ এগুলো ‘বৈধ’ (?) হয়ে উঠেছে।
অনুসন্ধানকালে নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন স্থানীয় টমটম চালক জানান, ‘আমরা জানি আমাদের এই বাহনটি অবৈধ। কিন্তু নেহায়েত পেটের দায়ে এটি চালিয়ে আমরা স্ত্রী-সন্তানদের মুখে দু’মুটো খাবার তুলে দেই। তবে এ জন্য আমাদের প্রতিমাসে রেজা-মুক্তাদির চক্রকে ৫শ’ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। এর বিনিময়ে ওরা আমাদের একটি করে বিশেষ স্টিকার লাগিয়ে দিয়ে বলে, ‘এটা থাকলে তোদের আর পুলিশে ধরবে না’। ‘তবে যদি কোন টমটম চালক চাঁদার বিনিময়ে স্টিকার নিতে রাজি না হয়, তাহলে রেজা-মুক্তাদির চক্র অস্ত্র হাতে ওই চালকের টমটম বা ব্যাটারিচালিত রিক্সার চাবি জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিয়ে যায়। আমরা এমন ফাঁপড়ে পড়েছি, এদের অপকর্মের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে গিয়েও কোন অভিযোগ দিতে পারছি না। আবার স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তির কথাও ওরা কানে তুলে না।’
অনুসন্ধানকালে আরো জানা গেছে, নিয়মনীতি ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জাউয়াবাজারে চলাচল করছে ১ হাজারের অধিক অবৈধ ইজিবাইক বা টমটম। অভিযোগ উঠেছে, ক্ষমতাসীন দলের নাম ভাঙ্গিয়ে রেজা-মুক্তাদির চক্র ‘জাউয়াবাজার অটোরিক্সা-ইজিবাইক মালিক ও শ্রমিক সমবায় সমিতি লিমিটেড’ নামে একটি অবৈধ সংগঠন গড়ে তুলেছে, যার কোন নিবন্ধন নেই। এই অবৈধ সংগঠনের নামে একটি সুদৃশ্য স্টিকার বাজারে ছাড়া হয়েছে। এতে সভাপতি হিসেবে রেজা তালুকদারের নাম লেখা রয়েছে। পাশে লেখা আছে, ‘চলন্ত অবস্থায় চালকের মোবাইল ফোনে কথা বলা নিষেধ, ট্রাফিক আইন মেনে চলুন, পুলিশকে সহযোগিতা করুন’। এ যেন প্রশাসন ও আইনকেই ব্যঙ্গ করে লেখা। লেখা দেখে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)-এর সমান্তরাল হিসেবে জাউয়াবাজারে এ দায়িত্ব পালন করছেন রেজা-মুক্তাদির চক্রের নিয়ন্ত্রণাধীন জাউয়াবাজার অটোরিক্সা-ইজিবাইক মালিক ও শ্রমিক সমবায় সমিতি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, রেজা-মুক্তাদির চক্রটি ইতোমধ্যেই অবৈধভাবে প্রায় ৫ লাখ টাকারও বেশী চাঁদা আদায় করেছে। শুধু তাই নয়, হেন অপকর্ম নেই, যা ওই চক্রটি করে না। ওদের গডফাদার যুক্তরাজ্য প্রবাসী মাহমুদ আলী ছাতক উপজেলার যেখানে-সেখানে ভ‚মি জবরদখলের কন্ট্র্যাক্ট রেখে রেজা-মুক্তাদির চক্রকে দিয়ে তা বাস্তবায়ন করিয়ে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
জাউয়াবাজারে কর্মরত সাবেক ট্রাফিক সার্জেন্ট হামিদুর রহমান ও বর্তমান সার্জেন্ট কামরুল ইসলাম এ প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে জানান, সাম্প্রতিক সময়ে জাউয়াবাজারে ১হাজারেরও বেশি ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক ছিলো। প্রতিদিনের পুলিশী অভিযানে এ সংখ্যা অনেকটা কমে গেলেও আবারও ক্ষমতাসীন দলের নাম ভাঙ্গিয়ে একটি প্রভাবশালী মহলের ছত্রচ্ছায়ায় তারা জোরর্প্বুক এই বাহনটি চালাচ্ছে। অবৈধ টমটম আটক বা মামলা করতে গেলেই স্বার্থান্বেষী চক্রের হোতাদের সাথে ধাক্কাধাক্কি, ঠেলাঠেলি বা হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে প্রতিনিয়ত। গত ১৩ মার্চ ট্রাফিক সাজেন্ট হামিদুর রহমান এ বেআইনি বিশেষ স্টিকার উপেক্ষা করে অবৈধ ইজিবাইক আটক করতে গেলে রেজা-মুক্তাদির চক্রের হাতে চরমভাবে লাঞ্ছিত হন। এ ঘটনার পর সার্জেন্ট হামিদুর রহমান বাদী হয়ে রেজাসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে ছাতক থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। যা থানায় রেকর্ডভ‚ক্ত হয়েছে।
ইজিবাইক মালিক ও শ্রমিক সমবায় সমিতি লিঃ-এর সভাপতি রেজা মিয়া তালুকদার তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত সকল অভিযোগ স্বীকার করে বলেন, ‘নিরিহ সাধারণ শ্রমিকদের কল্যাণে একটি সংগঠন তৈরি করেছি। এখানে আমার কোন স্বার্থ নেই।’ তিনি পাল্টা অভিযোগ করে বলেন, ‘আমার কল্যাণমুলক সামাজিক কার্যক্রমে ক্ষুব্দ হয়ে দীঘদিন ধরে একটি চক্র আমার বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচারে লিপ্ত।’
উত্থাপিত অভিযোগ সম্পর্কে ছাতক থানার ওসি শেখ নাজিম উদ্দিন সার্জেন্ট হামিদুর রহমানের অভিযোগসহ এসবের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন ‘অবৈধ স্টিকারের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের অপকর্মের যথাযথ তদন্তপুর্বক আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
জয়কলস হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ীর ইনচার্জ মুজিবুর রহমান জানান, ‘ব্যাটারিচালিত রিকশা বা ইজিবাইক মহাসড়কে চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এই অবৈধ বাহনের বিরুদ্ধে খুব দ্রæতই আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
প্রশাসনের এমনিতর আশ্বাসের মধ্যে সরকারের নীতি ও আদর্শ বিরোধী এবং আদালত অবমাননাকারী চক্রের বিরুদ্ধে জরুরী ভিত্তিতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ আবশ্যক বলে বিশেষজ্ঞ মহল মনে করেন। ###
(প্রতিবেদনটি দৈনিক সুনামগঞ্জ মিরর থেকে সংগৃহিত)