নারায়ণগঞ্জে মসজিদে বিস্ফোরণে নিহত ২০স্বজনদের আর্তনাদ
- আপডেট সময় : ০৮:০২:৫৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১২৫ বার পড়া হয়েছে
সিলেটের টাইমস ডেস্ক :: স্বজনদের আর্তনাদ, আহাজারি। আকস্মিক সব শেষ। মায়ের কাছে পানি চেয়েছিল ছোট্ট সন্তান। সেই শেষ কথা। কিছুক্ষণ পরেই মৃত্যু। নামাজ শেষে শোল মাছ দিয়ে ভাত খেতে চেয়েছিল ছেলেটি। তা আর কোনোদিন হবে না।
লাশের সারি আর খণ্ড খণ্ড ট্র্যাজেডি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থাপিত শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের বাতাসও যেন হয়ে ওঠে ভারি। একের পর এক আসছে মৃত্যুর খবর। বিলাপ করছেন নিহতদের স্বজনরা। কেউ কেউ ফ্লোরে গড়াগাড়ি দিচ্ছেন। চিৎকার করে কাঁদছেন। কান্নায় ভারি হয়ে উঠছে বাতাস। আবার ভবনের ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন অসংখ্য উদ্বিগ্ন মানুষ। তাদের অনেকেই জানেন না বিস্ফোরণে দগ্ধ স্বজন কেমন আছেন। সবাই বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের ভেতরে ঢুকতে চান। এক পলক দেখতে চান দগ্ধ স্বজনকে। তাদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন আনসার সদস্যরা। সকাল থেকে দুপুর। বাড়ছিল স্বজনদের আহাজারি। মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই হেরে যাচ্ছিলেন দগ্ধরা। বিকাল পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২০ জনে। তখনও আশঙ্কাজনক অবস্থা চিকিৎসাধীন ২০ জন। মসজিদের বিস্ফোরণের ঘটনা নিয়ে ইতিমধ্যে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এই বিস্ফোরণের ঘটনায় তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এরমধ্যে ফায়ার সার্ভিস একটি, তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ একটি ও জেলা প্রশাসন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। নিহতরা হলেন- মসজিদের মোয়াজ্জিন দেলোয়ার হোসেন (৪৮), মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কুদ্দুস বেপারী (৭২), ডাইং শ্রমিক হুমায়ুন কবির (৭০), নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবের স্টাফ নয়রুদ্দিনের দুই ছেলে জুবায়ের (১৮) ও সাব্বির (২১), রিফাত (১৮), মোস্তফা কামাল (৩৪), ইব্রাহিম (৪৩), জুনায়েদ (১৭), জামাল (৪০), জুয়েল (৭), জয়নাল আবেদিন (৪০), মাইনুদ্দিন (১২), কাঞ্চন হাওলাদার (৫০) , রাসেদ (৩০), নয়ন (২৭) ও রাসেল (৩০)।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। গতকাল সকালে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে এ কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খাদিজা তাহেরা ববিকে। এতে সদস্য করা হয়েছে নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) এটিএম মোশাররফ এবং ফায়ার সার্ভিস, তিতাস ও বিদ্যুতের উপ-পরিচালককে। নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন জানান, পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটিকে পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ ঘটনায় নিহতদের লাশ দাফনের জন্য তাদের প্রত্যেকের পরিবারকে ২০ হাজার এবং আহতদের চিকিৎসার জন্য ১০ হাজার টাকা অনুদান প্রদান করা হবে। গতকাল বিকাল পর্যন্ত ১৬টি লাশ স্বজনদের নিকট হস্তান্তর করা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ শহরের বায়তুস সালাত জামে মসজিদে শুক্রবার এশার নামাজের সময় বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটে। এ বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শী নির্মাণ শ্রমিক গিয়াস উদ্দিন জানান, তিনি মসজিদের পাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলছিলেন। হঠাৎ করেই বিকট শব্দ। চিৎকার। কান্নার আওয়াজ। কিছু বুঝে উঠার আগেই কেনান নামে এক তরুণ ‘বাঁচাও বাঁচাওগো’ বলে চিৎকার করে দৌড়াচ্ছিলো। কী হয়েছে জানতে চাইলে কেনান জানায়, তার শরীর পুড়ে গেছে। মসজিদের বিস্ফোরণ হয়েছে। প্রথমে তারা ধারণা করছিলেন বৈদ্যুতিক ট্রান্সমিটার থেকে বিস্ফোরণ ঘটেছে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় কেনান শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন।
গিয়াস উদ্দিন জানান, মসজিদের শতাধিক মুসল্লি ছিল। ফরজ নামাজ শেষ করে অনেকেই মসজিদ থেকে বের হয়ে যান। সুন্নত নামাজও প্রায় শেষ করছেন অনেকে। ঠিক তখনই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
তাৎক্ষণিকভাবে মসজিদের ভিতর গিয়ে বীভৎস দৃশ্য দেখতে পান। দগ্ধ হয়ে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছেন কেউ কেউ। কেউ বাঁচার জন্য আর্তনাদ করছেন। সবার শরীর ঝলসে লাল চামড়া মাংস বের হয়ে গেছে। মসজিদের মেঝে থেকে বুদ্বুদ করে গ্যাস বের হচ্ছিলো। মসজিদের ভিতের জায়নামাজ পুড়ে যায়। প্রায় ৪০ জনকে দগ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করা হয় বলে জানান গিয়াস উদ্দিন। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আধা ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
গতকাল শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে গিয়ে দেখা গেছে বাইরে-ভেতরে স্বজনদের ভিড়। অনেকে ভেতরে যেতে চেষ্টা করছেন। দগ্ধ স্বজনকে কাছ থেকে দেখতে চাচ্ছেন। কেউ কেউ ভেতরে ওয়েটিং রুমে বসে আছেন। আনসার সদস্যরা রোগীর স্বজনকে মাইকে ডাকছেন। স্বজনের দগ্ধ চেহারা দেখে কান্না ভেঙে পড়ছেন। এরমধ্যেই আসছে মৃত্যুর খবর। বুক ভাঙা আর্তনাদে ভারি হয়ে উঠেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকার বাতাস।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক চিকিৎসক পার্থ শংকর পাল জানান, বিস্ফোরণে দগ্ধ রোগীদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে। চিকিৎসাধীন ২০ জনের অনেকেরই শ্বাসনালী পুড়ে গেছে। তারা আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছেন বলে জানান তিনি।
ছোট ভাই ফিরে এলো লাশ হয়ে: মাইনুদ্দিন। বয়স মাত্র ১২ বছর। নিয়মিত নামাজ পড়তে যেতেন মসজিদে। শুক্রবার রাতেও গিয়েছিলেন এশার নামাজ আদায় করতে। ছোট ভাইয়ের অপেক্ষায় রাতভর অপেক্ষা করছিলেন বোন বিউটি। ভাইয়ের কি অবস্থা জানার জন্য ব্যাকুল। কিন্তু কিছুই জানতে পারছিলেন না।
বিউটি বলেন, হঠাৎ শুনতে পারি মসজিদে আগুন লাগছে। দৌড়ে মসজিদের দিকে যাই। সেখানে গিয়ে শুনি ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে নিয়ে গেছে সবাইকে। হাসপাতালে গিয়ে শুনি ঢাকায় নিয়ে গেছে ছোট ভাইকে। এরই মাঝে একটি ফোন আসে। তার ছোটভাই মাইনুদ্দিন বোনের মোবাইল নম্বর দেন তাকে। দিয়ে বলতে বলেন, ঢাকায় গিয়ে যেন দেখা করে। এও জানায়, ভাইয়ের শরীরের অনেকটাই পুড়ে গেছে।
করোনায় চাকরি আর বিস্ফোরণে হারালেন স্বামীকে: করোনায় চাকরি হারানোর পর এবার স্বামীকে হারালেন নাসরিন। বার্ন ইনস্টিটিউটের সামনে চেয়ারে বসে বারবার চিৎকার করে উঠছিলেন তিনি। বলছিলেন, তার স্বামীর চিকিৎসাটা যেন ভালোভাবে হয়। নাসরিন বলেন, আমার স্বামীর নাম ইব্রাহীম। প্রতিদিনের মতো নামাজ পড়তে গিয়েছিল। মসজিদের পাশেই বাড়ি আমাদের। হঠাৎ চিৎকার শুনি, আগুন লাগছে। কারেন্ট বন্ধ কর। কারেন্টের সব সুইচ বন্ধ করে দেই। এরপর পাশের বাসার একজন বলেন, আগুন লাগছে মসজিদে। তখন মনে হয় ওতো নামাজ পড়তে গেছে। কোনোরকম বোরকা পরে মসজিদের দিকে যাই। দেখি তার শরীরের অধিকাংশ অংশই পুড়ে গেছে। তাকে স্থানীয় লোকজন হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে নিয়ে আসে ঢাকায়। এখানেও ছুটে আসি। তিনি জানান, দু’জনই চাকরি করতেন গার্মেন্টসে। করোনাকালে চাকরি হারিয়েছেন তিনি। স্বামীর আয়ে কোনোরকম চলছিল সংসার। গতকাল শনিবার খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মৃতদের তালিকায় তার স্বামীর নামটাও রয়েছে।
রাতভর বার্ন ইনস্টিটিউট চত্বরে সরজমিন দেখা যায় গেটের বাইরে ও ভিতরে স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে আছে পরিবেশ। থেকে থেকে ভেসে উঠছিল কান্নার রোল। রাতেই ছুটে এসেছিলেন নারায়ণগঞ্জ উপজেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা নাহিদা বারিক। তিনি গণমাধ্যমে বলেন, এই মুহূর্তে তাদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতকরণই প্রধান দায়িত্ব। মসজিদের আশেপাশের গ্যাস লাইন কী অবস্থায় ছিল তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। রাতেই গণমাধ্যমে ব্রিফ করেন বার্ন ইনস্টিটিউটের সহকারী পরিচলাক ডা. হোসেন ইমাম। তখনো কেউ মারা যাননি। এমতাবস্থায় তিনি বলেন, প্রত্যেকের অবস্থায় সংকটাপন্ন। প্রত্যেকেরই শ্বাসনালীর অন্তত ৩০ শতাংশ পুড়ে গেছে।
রাতে গেটের বাইরে দেখা যায় উৎসুক জনতার ভিড়। স্বজনদের থেকে অধিক পরিমাণে ছিলেন তারা। তাদের নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। এ ছাড়াও স্বেচ্ছাসেবীরাও কাজ করেন সেখানে। এতো পরিমাণ উৎসুক জনতার ভিড় থাকলেও রক্ত দিতে অনীহা দেখা যায় তাদের মাঝে। রেড ক্রিসেন্টের সদস্যরা হ্যান্ড মাইকে বারবার রক্তের জন্য আবেদন করলেও এগিয়ে আসেননি কেউ। তারা দীর্ঘসময় ঘোষণা দেবার পর মাত্র চারজন রক্ত দেবার ইচ্ছা পোষণ করেন। এ ছাড়াও তারা স্বজনদের খাবার পানি ও রুটি সরবরাহ করছিলেন।
বাঁচাও বাঁচাও: মসজিদের পাশেই চায়ের দোকানে ছিলেন মাসুদ রানা। হঠাৎ বিস্ফোরণের শব্দ শোনেন। এগিয়ে দেখেন শুধুই কালো ধোঁয়া। আর দেখি আগুন জ্বলছে।